চকরিয়ার মাতামুহুরী ট্রাজেডির সাত বছর : আজো সন্তানদের খুঁজে ফেরেন পাঁচ পরিবার

প্রকাশঃ Jul 14, 2025 - 12:19
চকরিয়ার মাতামুহুরী ট্রাজেডির সাত বছর : আজো সন্তানদের খুঁজে ফেরেন পাঁচ পরিবার

সাতটি  বছর পেরিয়ে গেছে। কিন্তু চকরিয়ার পাঁচ পরিবার আজো দিন গণে ২০১৮ সালের ১৪ জুলাইয়ের দুঃস্বপ্নের দিনটিকে। সময় থেমে আছে তাদের জন্য। সেই দিন বিকেলে মাতামুহুরী নদীর স্রোতে হারিয়ে যায় পাঁচ কিশোর, যারা ছিল তাদের পরিবার, বিদ্যালয় ও সমাজের গর্ব।এক বিকেলে হারিয়ে গেল পাঁচ জীবন : চকরিয়া গ্রামার স্কুলের ১০ম ও ৮ম শ্রেণির পাঁচ শিক্ষার্থী পরীক্ষার পর বিকেলে ফুটবল খেলতে যায় চিরিঙ্গা ব্রিজের কাছেরবালুচরে। খেলার শেষে সবাই মিলে নামল নদীতে গোসল করতে। কিছু সময়ের মধ্যেই কিশোরদের কোলাহল থেমে যায়। নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা পথচারীরা প্রথমে কিছু টের পাননি। কিন্তু একসময় নদী থেকে একে একে ভেসে উঠতে থাকে নিথর দেহ।নিহতরা হলেন: আমিনুল হোসেন এমশাদ (১০ম শ্রেণি), মেহরাব হোসেন (৮ম শ্রেণি)। তারা ব্যবসায়ী আলহাজ আনোয়ার হোসেনের সন্তান, সায়ীদ জাওয়াদ (১০ম শ্রেণি) অধ্যক্ষ রফিকুল ইসলামের ছেলে। তূর্য ভট্টাচার্য (১০ম শ্রেণি), জলি ভট্টাচার্যের সন্তান,মোঃ ফারহাদ (১০ম শ্রেণি), স্থানীয় বাসিন্দা শওকতের সন্তান।সন্তান হারানোর বেদনা : শেষ হয়নি এখনো-মাতামুহুরী নদীর পাড় ঘেঁষে আজও বসে থাকেন জাওয়াদের মা। ছেলের ব্যবহৃত জামা আজো তুলে রাখেন আলমারির ভাঁজে। মেহরাবের বাবার ঘরে তার লেখাপড়ার পুরোনো খাতা যেন আরেকটি কবর। তূর্যর মা এখনো মানসিকভাবে পুরোপুরি সুস্থ নন—প্রতিদিন সন্তানের কণ্ঠ খোঁজেন বাতাসে।আনোয়ার হোসেন, যিনি দুই ছেলেকে হারিয়েছেন, বলেন,"আমার পৃথিবীটাই বদলে গেছে। আজ সাত বছর, কিন্তু মনে হয় যেন গতকাল। দুই ভাই পাশাপাশি পড়ত, খেলত। একসাথে গিয়েও একসাথেই চলে গেল।"অধ্যক্ষ রফিকুল ইসলাম বলেন,আমি শুধু একজন পিতা নই, শিক্ষার্থী হারিয়েছি শিক্ষক হিসেবে। আমার স্কুলের প্রাণ ছিল ওরা।"চকরিয়া গ্রামার স্কুলে প্রতি বছর দিনটি স্মরণ করা হয়। শিক্ষার্থীরা মোম জ্বালায়, কবিতা পড়ে, দোয়া মাহফিল করে। কিন্তু পরিবারগুলো অভিযোগ করে, প্রশাসনিক বা সরকারি পর্যায়ে কোনো স্থায়ী উদ্যোগ নেয়া হয়নি।জলি ভট্টাচার্য বলেন,"আমরা চাইছিলাম ওদের নামে নদীর পাশে একটা স্মৃতিফলক হোক। কেউ এগিয়ে আসেনি। আমাদের সন্তানদের যেন সবাই মনে রাখে, এইটুকুই চাওয়া।"মাতামুহুরী নদী, বান্দরবান পাহাড়ি অঞ্চল থেকে নেমে আসা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অন্যতম উৎস। কিন্তু এর প্রবল স্রোত, বিশেষ করে বর্ষাকালে, অনেক সময় হয়ে ওঠে মৃত্যুকূপ। শিশু-কিশোরদের জন্য গোসল বা সাঁতারে ন্যূনতম নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই।

স্থানীয় সাংবাদিক জামাল উদদীন  বলেন,"এই ঘটনার পরে অন্তত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানভিত্তিক সচেতনতামূলক কার্যক্রম হওয়া উচিত ছিল। কোথাও কোনো সচেতনতামূলক কর্মসূচি আমরা দেখিনি।"স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিক সহযোগিতা ছাড়া দীর্ঘমেয়াদি কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। এখন পর্যন্ত: নদীর পাশে কোনো সতর্কতামূলক বোর্ড নেই,ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে বাঁধ বা বেড়া নির্মাণ হয়নি।এক অভিভাবক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, "প্রতিটি শিক্ষার্থী একটি পরিবারের ভবিষ্যৎ। নদী যদি তাদের কেড়ে নেয়, রাষ্ট্র কি শুধু দেখে যাবে?"এই ঘটনাটি আমাদের শেখায়, সাবধানতার ঘাটতি, সচেতনতার অভাব আর অব্যবস্থাপনাই শিশুদের জীবনে বড় বিপদ ডেকে আনতে পারে। কেবল মোমবাতি জ্বেলে নয়, আমরা যদি সত্যিকারের স্মরণ করতে চাই, তবে দায়িত্ব নিতে হবে—বিদ্যালয়, পরিবার, প্রশাসন সবাইকে।চকরিয়ার মাতামুহুরী নদী আজো শান্তভাবে বইছে। কিন্তু তার বুকে চাপা পড়ে আছে পাঁচটি নিষ্পাপ প্রাণের গল্প। গল্প নয়, ট্রাজেডি। এই ট্রাজেডির যেন আর পুনরাবৃত্তি না হয়—এই হোক সাত বছর পরে আমাদের সবার অঙ্গীকার।