একমুঠো ভাত

সাদিয়া হোসেন মাধুরী
শ্রাবণী আর দিহান বসে আছে একটি নামিদামি রেস্টুরেন্টে। পাশের চার-পাঁচটি টেবিলজুড়ে একটা পার্টি হচ্ছে। এলাকার ধনী লোকদের উঠতি বয়সী ছেলেমেয়েরা বন্ধুর জন্মদিন পালন করছে। দিহান বলল, ‘দেখছো, ছেলেমেয়েগুলার অবস্থা। খাবার খাওয়ার চেয়ে নষ্ট করায় ওদের মনোযোগ বেশি।’ ‘হ্যাঁ, তাই তো দেখছি।’ স্যান্ডউইচের একটা টুকরো মুখে পুরে গম্ভীর হয়ে বলে শ্রাবণী। এক টুকরো চিবিয়ে পেটে চালান করেই নামিয়ে রাখে স্যান্ডউইচ। ‘ওই দেখছো, এত বড় কেক আনলো আর খাওয়ার জায়গায় সেটার অর্ধেকেরও বেশি মাখিয়ে ভূত হয়ে সেলফি তোলায় ব্যস্ত সবগুলো।’ ‘দেখো, আবার হুড়োহুড়িতে বক্স সমেত পিৎজাটাও নিচে পড়ে গেল। এটা তো আর উঠিয়ে নিশ্চয়ই খাবে না ওরা। তারপর এগুলো সবই যাবে ডাস্টবিনে।’ ‘রাইট। একটা মাকাল ফল জেনারেশন পেতে যাচ্ছি।’ এক চামচ স্যুপ মুখে তুলে বলে শ্রাবণী। চিকেন ফ্রাইটা কামড়ে রেখে মেজাজ খারাপ করে বলল দিহান, ‘দেশটায় প্রতিনিয়ত এভাবেই খাবার নষ্ট হচ্ছে। ওই দেখো, প্লেটে সব ঝুটা করে রেখে দিয়েছে, রাবিশ।’ ‘ধ্যাত, কী সব খাবার যে বানায় এরা। আর এত নামি রেস্টুরেন্ট। ওঠো তো, আর খাবো না। ওয়েটার বিল নিয়ে আসো কুইক।’ ওরা বিল মিটিয়ে চলে যেতেই ওয়েটার মুবিন টেবিলের খাবারগুলো তুলে নিতে আসে। এতগুলো খাবার অথচ কিছুই ঠিকভাবে খেলো না। বসে বসে অন্য টেবিলের মানুষ খাবার অপচয় করছে, তা নিয়ে আলোচনা করলো। মুবিন করুণ দৃষ্টিতে খাবারগুলোর দিকে একপলক তাকিয়ে ট্রেতে সব উঠিয়ে নেয়।
২.
স্কুলে টিফিন পিরিয়ডে রাইসা এক বাটি চাউমিন স্কুলের ডাস্টপ্যানে ফেলে দেয়। স্কুল গ্রাউন্ডের বকুল গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে মিতু সবটা দেখলো। ভয়ে ভয়ে কাছে এসে বলল, ‘তুই এতগুলা খাবার ফেললি কেন?’ ‘আমার ক্ষুধা নেই। তাই ফেলে দিলাম। না হলে ব্যাগে থাকলে নষ্ট হয়ে যাবে। কিন্তু তাতে তোর কী?’ ‘তুই অন্য কাউকে দিতে পারতি। তোর টিফিনটা অন্য কাউকে ভাগ দিলে তো আর অপচয়টা হতো না।’ ‘হুহ, দেখো চাষার মেয়ে বলে কী।’ মুখ বাকিয়ে চলে গেল রাইসা। রাইসার বাবার অঢেল টাকা-পয়সা থাকায় সে মধ্যবিত্ত যে কাউকে চাষাই জ্ঞান করে।
৩.
জাহেদ একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে এসেছে। বরপক্ষ আসতে অনেক দেরি করছে। এদিকে অতিথিরা সব ক্ষুধার জ্বালায় অস্থির হয়ে রাগারাগি করছে। তাই সবাইকে দ্রুত খাবার দিয়ে দেওয়া হয়। জাহেদ খাবার টেবিলে বসে দুই লোকমা মুখে পুরেই লক্ষ্য করে, তার এবং আশেপাশের টেবিলের লোকজন প্রচুর খাবার নষ্ট করছে। যতটুকু না খাচ্ছে; তার চেয়ে বেশি ঝুটা করে রাখছে। তার পাশের ভদ্রলোক নিজের ইচ্ছেমতো খাবার নিচ্ছেন বেশি বেশি করে। জাহেদ লোকটিকে বলে, ‘ভাই আপনি যতটুকু না খাচ্ছেন তার দ্বিগুণ প্লেটে নিচ্ছেন। কারণটা জানতে পারি?’ লোকটি তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে, ‘আরে মিয়া ট্রেন্ড শিখলা না। বিয়ে মানেই কবজি ডুবিয়ে খাওয়া আর পয়সা উসুল। হা হা।’ জাহেদ বিনয়ের সাথে বলে, ‘না ভাই, ভুল বললেন। খাবার নষ্ট করা নিশ্চয়ই কোনো ট্রেন্ড নয়। একজন বাবার অনেক কষ্টের টাকায় এ আয়োজন। আমাদের অবশ্যই উচিত নয় এর অসম্মান করা।’ লোকটি এবার রেগে যায়, ‘ওই মিয়া থামো। তোমার লেকচার শুনতে আসিনি। আমার প্লেটের খাবার আমি ফালাই, নষ্ট করি; তাতে তোমার কী। যত্তসব আসে জ্ঞান দিতে।’ জাহেদ হতাশ হয়।
৪.
আকাশে ঈষৎ মেঘ করেছে। শেষ বিকেলে নিজেদের জমিতে বাবার সাথে কাজ করতে করতে সবুজ বলে, ‘আব্বা, কোন দ্যাশে নাকি যুদ্ধ লাগসে। দেশে খাদ্য সংকট দেখা দিবো। বেবাক না খাইয়া নাকি মরবো?’ সবুজকে চিন্তিত ও ভীত মনে হয়। ‘হ বাজান, দ্যাশের অবস্থা খুব খারাপ আর জিনিসপত্রের দাম দিন দিন হু হু কইরা বাড়তাসে। কিসসু করার নাই বাজান। সবার উচিত, যার যা জমি আছে বাড়ির পাশে যতুটুক জায়গা আছে; তাতেই যেন চাষবাস করে ফসল ফলায়।’ ‘আব্বা, দ্যাশের মানুষ তো বোঝে না। খালি অপচয় করে সবাই। এদিকে আমরা গরিবরা না খায়া মরি; তা-ও এক দানা রিজিক নষ্ট করি না।’
৫.
দিন এভাবেই গড়িয়ে যেতে থাকে অপচয়ে, মানুষের অসচেতনতায়। একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই দিহান কিছুক্ষণ এক্সারসাইজ করে। তারপর ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা দুধ পান করে। আজ ফ্রিজ খুলে দেখে সব খালি। বাসায় আজ দুইদিন ধরে বাজার নেই। বুয়া আসে না আজকে পাঁচদিন হলো। কিছুটা গজ গজ করতে করতে দিহান দুধ ও অন্যান্য গ্রোসারি আইটেম আনতে বাসার নিচের সুপার শপে যায়। কাঁচা বাজারেও যেতে হবে এক ফাঁকে। বাসার নিচে আসতেই দিহান লক্ষ্য করে, দোকানপাট সব ফাঁকা। একটা সুপারশপের কাছে যেতেই দেখে ওটার গ্লাস ভাঙা। ভেতরে কোনো লোক নেই। কাউন্টার ফাঁকা আর ভেতরে অনেক মানুষ হুড়োহুড়ি করে খাবার নিয়ে রাক্ষসের মতো খাচ্ছে। দিহান আরেকটু এগোতেই দেখে ফ্লোরে দোকান মালিক মৃত পড়ে আছে। আঁতকে ওঠে দিহান। খাবার লেপ্টে থাকা মুখে একটি লোক দিহানের দিকে এক খাবলা খাবার এগিয়ে দিয়ে কুৎসিত হাসি হেসে বলে, ‘খাবি? হে হে, নে... খা। পেটে অনেক ক্ষুধা বুচ্ছোস, অনেক ক্ষুধা। আ হা হা হা।’ দিহানের নাড়িভুড়ি উল্টে আসে। দৌড়ে পালায়। অবস্থা আসলেই খুব খারাপ। খাদ্য সংকট চলছে। পরিস্থিতি এতটা ভয়ংকর হবে সে ভাবেনি। টানা এক সপ্তাহ পর সে বাসা থেকে বের হয়েছিল। ঘরের মজুত খাবার সব শেষ। কাঁচা বাজার খা খা করছে। কেউ কিছু বিক্রি করতে আসেনি। আসবে কোত্থেকে, দেশে যে বিরাট সংকট চলছে। দিহানের মাথার ওপর রোদ ঝা ঝা করছে। পাশের ডাস্টবিনে অনেক কাক আর কিছু মানুষও আছে। তারা কী যেন খুঁজছে। সবার পেটেই ভীষণ ক্ষুধা। রাইসারা গাড়ি করে গ্রামের বাড়ি যাচ্ছে। ঢাকা শহরে থাকা এখন আর নিরাপদ মনে হয় না। দিন দিন শহর কেমন বিরান হয়ে যাচ্ছে। রাস্তার আশেপাশে আজকাল অনাহারে ভোগা শীর্ণকায় মৃতদেহ দেখতে পাওয়া যায়। গাড়ি একটা গ্রাম্য পথে আসার পর কোথা থেকে অনেকগুলো মানুষ এসে তাদের পথ আটকায়। সবার কণ্ঠে এক রব, ‘ওই ওই খাবার দে খাবার। একমুঠা ভাত দে। অনেক ক্ষিধা পেটে। খাবার চাই। ভাত চাই।’ লোকগুলো ক্ষুধা-তৃষ্ণায় হিতাহিত জ্ঞানশূন্য পশুর মতো গাড়ির জানালার গ্লাসে আঘাত করতে থাকে। গাড়ির ড্রাইভার আতঙ্কিত হয়। বাবা-মাকে জড়িয়ে ধরে ভয়ে কাঁপতে থাকে রাইসা। পশ্চিম আকাশে সূর্য হেলে পড়েছে। সবুজের আব্বা মাঠ থেকে বাড়িতে ফেরে ভগ্ন হৃদয় নিয়ে। তার জমিটা আর জমি নেই। বিরান হয়ে আছে। শেয়াল-কুকুর চড়ে বেড়ায়। এবার হয়তো ছেলেকে নিয়ে না খেয়েই মরবে। মৃত্যুর মিছিল শুরু হয়েছে। অনাহারে মৃত্যু। ছেলেটার জ্বর আজ তিনদিন ধরে। না খেয়ে আছে সকাল থেকে। হাড়িতে একমুঠো ভাত আছে শুধু। তরকারির বাটিতে সামান্য একটু আলুর শুকনা তরকারি। থালায় ভাত বেড়ে ছেলেকে ঘুম থেকে উঠিয়ে কোলে বসায় খাওয়ানোর জন্য। সে নিজেও দুইদিন ধরে না খেয়ে আছে। ছেলেটার মুখের দিকে তাকালে সব ক্ষুধা-তৃষ্ণা ভুলে যায় মনসুর। সবুজকে খাওয়াতে যাবে, এমন সময় বন্ধ দরজায় অনেকগুলো মানুষের কড়া নাড়ার শব্দ। সবার এককথা, ‘অনেক ক্ষুধা পেটে। অনেক ক্ষুধা রে। ভাত দে, একমুঠো ভাত দে।’ সবাই তারস্বরে চেচাচ্ছে, ‘একমুঠো ভাত চাই। পেট ভরে খাবো।’ মনসুর ছেলেকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। যে কোনো মুহূর্তে দরজা ভেঙে পড়বে। সবুজ ভয়ে আব্বার কোলে গুটিয়ে নেয় নিজেকে। মানুষ ক্ষুধার তাড়নায় এখন পশু। তাকে পেলে খুবলে খুবলে খাবে। বাইরে থেকে তখনো চিৎকার ভেসে আসছে, ‘একমুঠো ভাত। একমুঠো ভাত।’