২৮শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ ❑ ১৫ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
১৮ই শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি ❑ রবিবার

দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া; একজন শঙ্করের জীবন কথা

অনলাইন ডেস্ক, অধিকরণ ডট কম

অধিকরণ অনলাইনের সর্বশেষ খবর পেতে গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি অনুসরণ করুন

বিজ্ঞাপন

আবদুল কাদের খান:

“প্রতিদিন কত খবর আসে যে কাগজের পাতা ভরে, জীবন পাতার অনেক খবর রয়ে যায় অগোচরে।”
আমাদের তারুণ্যের দিনগুলোতে ওই শতাব্দীর ১৯৬৮ সালে কলেজ পালিয়ে “এতটুকু আশা” যে শিক্ষামূলক চলচ্চিত্রটি দেখেছিলাম, সেই পাকিস্তান আমলে, এই চলচ্চিত্রের একটি বেদনাদায়ক চিত্রে এই গানটি পরিবেশিত হয়েছিল।

বিজ্ঞাপন

আমাদের চেনা ভুবনের বাসিন্দা, খুলনার ডুমুরিয়া বারো আনি বাজারের নৈশ প্রহরীদের কমান্ডার, শংকর দেবনাথ এর জীবনের নেপথ্য কথা বলছিলাম।

বয়স অনেক আগেই ষাটের কোঠা অতিক্রম করেছে।স্মার্টনেস দেখে তা মনে হয় না। তাকে জিজ্ঞাসা করায় বলল, আমার বয়স এখন ৬৫ বছর।

ডুমুরিয়া উপজেলা সদরের শোভনা ইউনিয়নের চিংড়া গ্রামের কালিপদ দেবনাথ এর পুত্র এই শংকর দেবনাথ।
কালিপদ দেবনাথ এর সন্তানদের মধ্যে শংকর ই বড় থাকায় অস্বচ্ছলতা এবং দারিদ্র্যের কারণে কোনদিন স্কুলে যেতে পারে নাই। আবার টেনেটুনে চলা সংসারে জোড়া তালি দিতে দিতেই বড় হয়েছে। স্ত্রী লক্ষ্মী, মেয়ে কল্পনা এবং দু’পুত্র নিতাই আর আনন্দ এই তিন সন্তানকে নিয়ে তার সংসার। বড় বিচিত্র তার জীবন।

কেশবপুরের ব্রহ্মকাটি গ্রামের লক্ষ্মীরানীর সাথে সংসার পাতেন তা’ প্রায় চল্লিশ বছর আগে। মাত্র ২০০০ টাকা বেতনে নৈশ প্রহরীর কাজ শুরু করেন, ওই শতাব্দীর ৮৮ সালে। এর মধ্যে ৩৫ বছর কেটে গেছে।

বিজ্ঞাপন

জীবন গঙ্গায় অনেক ঢেউ, অনেক বিরুদ্ধ স্রোত পাড়ি দিয়েছেন এই মানুষটি। কখনো হার মানেননি।
কথা হচ্ছিল ডুমুরিয়া বারওয়ানী বাজারে মাংস পট্টির সামনে দাঁড়িয়ে। সস্নেহ সম্বোধনে বললাম, শংকর বাবু তোমার খবর কি ? আমাকে দেখেই পদযুগল স্পর্শ করে অত্যন্ত শ্রদ্ধা সহকারে প্রণাম করে বললেন, স্যার ভালো আছি। আমি ওকে বুকে নিয়ে জড়িয়ে ধরলাম। চাকরিটা ছোট হতে পারে কিন্তু মনটা অত্যন্ত উদার। শ্রেণী নির্বিশেষে, সবাইকে আপন বলে সম্মান শ্রদ্ধা ও স্নেহ করে।

মাত্র সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা বেতনে রাত এগারোটা থেকে ভোর ৫-৪৫ টা পর্যন্ত বাজার পাহারার কাজ। কঠিন দায়িত্বপূর্ণ কাজ। যে কাজে বিন্দুমাত্র ফাঁক নেই। আমরা যখন নিদ্রা দেবীর কাছে মোলায়েমভাবে আত্মসমর্পণ করি এবং দিন দুনিয়ার কোন খবরই জানা থাকে না।

শংকর তখন বাঁশি ফুঁকে ফুঁকে এ গলি সে গলি পাড়ি দিয়ে, বাজারের দোকানদারদের মালামালের নিরাপত্তাবিধানের নজরদারি করে চলে। এই তো জীবন!

বিজ্ঞাপন

অকালে পিতার মৃত্যুর পর বিভিন্ন ধরনের শত্রুতা মূলক মামলা মোকরদ্দমায় নিঃস্ব হয়ে শেষ পর্যন্ত ৮৮ সালে বাজারে আসে সামান্য নৈশ প্রহরীর কাজ নিয়ে মাত্র ২ হাজার টাকা বেতন। সেই থেকে শুরু। এরমধ্যে ৩৫ বছর গড়িয়ে গেছে।

আমার বাল্যবন্ধু ডুমুরিয়া বারওয়ানী বাজার এর( নামজাদা প্রয়াত ডাক্তার জানকি রায়ের পুত্র) সুখ্যাত ডা. গৌরকিশোর রায় এর আশ্রয়ে বাজারে নৈশ প্রহরীদের কমান্ডার হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করে চলেছেন।
তার চরিত্রের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য ব্যক্তিগত জীবনে দায়িত্ব পালনে অত্যন্ত নিষ্ঠাবান। ৩৫ বছরের নৈশ প্রহরি জীবনে প্রায় এক যুগ আগে পিতা মারা গেছেন, ৮-৯ বছর আগে মা মরেছেন কিন্তু তিনি একদিনও কর্তব্য কাজে পিছিয়ে যাননি অর্থাৎ ছুটি নেননি। পিতা মাতার লাশ ঢাকা রয়েছে, শংকর বাঁশি বাজিয়ে বাজারে অন্য মানুষের মালামালের নিরাপত্তা বিধানে অকাতরে ডিউটি পালন করে গেছেন, কোনো অজুহাতেই ছুটি নেননি। কি বিচিত্র তার জীবন! সাংঘাতিক কর্ম নিষ্ঠা!

বাজারের নৈশ প্রহরির কমান্ডার হিসেবে প্রায় ২০ বছর দায়িত্ব পালনে কোন শৈথিল্য দেখান নি। ভাবতে দারুন অবাক লাগে, শরীরে ১০৪ ডিগ্রি জ্বর, ডায়রিয়া হয়েছে, আমাশয়এ ভুগেছেন, কিন্তু বাজার পাহারার কাজ থেকে একদিনও ছুটি নেননি। দীর্ঘ ৩৫ বছরের কর্মজীবনে।

জিজ্ঞাসা করায় তিনি জানালেন, ডুমুরিয়া থানার পাশে অবস্থিত মুক্তিযোদ্ধা ভবন থেকে শুরু করে, সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হুমায়ুন বুলুর মার্কেট এলাকা হয়ে পালপাড়া মোড় দুধ হাটা রেখে ডুমুরিয়া ইউনিয়ন পরিষদ ভবন সংলগ্ন চাল ব্যবসায়ী তপন সাহার আড়ৎ পর্যন্ত তার পাহারার এলাকা। বাজারের প্রায় ৮০০ -৮৫০ দোকানের নিরাপত্তার দায়িত্ব মাত্র পাঁচ জন পাহারাদার পালন করেন।

কী বিচিত্র জীবন। বিচিত্র পেশা!

শংকর দেবনাথ এর কষ্টে মোড়ানো জীবনে দুঃখ দারিদ্র্য তাকে কুরে কুরে খায়, কিন্তু শত দুঃখ কষ্ট গোপন রেখেও আমাদের ভদ্র সমাজের মানুষগুলোকে তিনি অসম্ভব সম্মান করেন। আমাকে বলছিলেন, আমার প্রিয় ব্যক্তিত্ব বর্তমান খুলনা-৫ (ডুমুরিয়া- ফুলতলা) আসনের সাংসদ বাবু নারায়ণ চন্দ্র চন্দ, অন্য প্রিয় ব্যক্তিদের তালিকায় আছেন : শোভনা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল গনি সরদার, প্রয়াত মেম্বার শেখ হামিদার।

বাজারের সাবেক সভাপতি বন্ধুবর ডাক্তার গৌর কিশোর রায় সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি সলজ্জ হেসে বললেন, সৃষ্টি কর্তার কৃপায় উনার আশ্রয়েই তো আছি, গত ২০ বছর।

আমাদের বিত্তশীল সচ্ছল সমাজে শংকর রা অত্যন্ত উপেক্ষিত, কিন্তু পেশার মূল্যায়নে শংকর এ দেশ সমাজের কাছে স্যালুট পাওয়ার যোগ্য।নিজের ঘরের খবর হয় না, অথচ পরের পাহারাদারীর কাজে সে সকল সময় ব্যস্ত।

লেখকঃ সাংবাদিক ও কলামিস্ট

বিজ্ঞাপন

সংবাদটি শেয়ার করুন

নিউজলেটার সাবসক্রাইব

জনপ্রিয়

আপনার জন্য আরো কিছু সংবাদ
সম্পর্কিত

পর্যটন ব্যবসা এগিয়ে নিতে নেপাল-বাংলাদেশ এলায়েন্স গঠন

কাঠমান্ডু (নেপাল) সংবাদদাতা নেপাল বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশীপ অ্যাসোসিয়েশন (এনবিএফএ) গতকাল সকালে...