কুরসিয়া জামান প্রিতম :
পথশিশু, শব্দটা শুনলেই চোখের সামনে বেশে ওঠে কিছু নিষ্পাপ-নিরীহ ও অসহায় চেহারা। কেননা, রাস্তায় বের হলেই দেখা মিলে এমন অসংখ্য পথশিশুর মুখ। তাই শব্দটা শুনার মুহূর্তেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে। যদি কখনো কাউকে প্রশ্ন করা হয় ‘পথশিশু কাকে বলে’? তখন খুব সহজেই উত্তর আসে যে, যাদের বাড়িঘর নেই, যারা রাস্তায় থাকে তাদেরকেই পথশিশু বলে। খুব সহজ উত্তর। কিন্তু এই রাস্তায় থাকা পথশিশুদের জীবনটা বড়ই কঠিন। মৌলিক চাহিদা ও সুযোগ থেকে দূরে থাকা এই শিশুগুলো শুধু পারিবারিক যত্ন ও সুরক্ষা থেকেই বঞ্চিত নয়, নির্যাতন, অবহেলা ও মৃত্যুরও মুখোমুখি হয়।
এবার যদি প্রশ্ন আসে, কেন জন্মায় পথশিশুরা? কেন তাদের পথেই থাকতে হয়? তখন স্বাভাবিক যে উত্তরটা আসে- পথশিশু তৈরি হওয়ার মূল কারণ হচ্ছে দারিদ্রতা। কিন্তু শুধু দারিদ্রতাই নয়, পরিবার ভেঙ্গে যাওয়া, গ্রাম-শহর অভিবাসন, বাবা-মায়ের বিবাহবিচ্ছেদ অথবা একাধিক বিয়ে কিংবা তাদের মৃত্যু, আশ্রয়ের অভাব, পারিবারিক কলহ ও হারিয়ে যাওয়াসহ নানা কারণে বাড়ি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে শিশুরা পরিণত হয় পথশিশুতে। ঢুকে পড়ে এক অনিশ্চিত জীবনে।
কেউ জানতে চায়না কেমন আছে এই পথশিশুগুলো। মানুষের উচ্ছিষ্ট খেয়ে দিন কাটায় তারা। খোলা আকাশ, ফুটপাত, ফেরিঘাট, লঞ্চ টার্মিনাল, পার্ক, বাসস্টেশন বা রেলস্টেশনই তাদের বাসস্থান। কখনো কখনো শিকার হচ্ছে শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের। বিশেষ করে মেয়ে শিশুগুলো যৌন নিপীড়ন ও ধর্ষণের শিকার হচ্ছে বেশি। তাছাড়াও এই শিশুরা উদ্বেগ, বিষণ্ণতা ও হতাশায় জড়িয়ে পড়ে নানা অপকর্মের সঙ্গে। অর্থাৎ শিশুদের যত ধরনের ঝুঁকি রয়েছে সব ধরণের ঝুঁকির মধ্যেই রয়েছে পথশিশুরা৷
একদিন রাজধানীর সংসদ ভবন এলাকায় বসে ছিলাম। হঠাৎ ৫-৬ বছরের ছোট একটি বাচ্চা মেয়ে হাতে এক গুচ্ছ গোলাপ নিয়ে এসে বলছে, আপু একটা ফুল নিবেন? মেয়েটার দিকে তাকালাম, কি মিষ্টি একটা মেয়ে, চুলগুলোও সুন্দর করে আচরানো। সচারাচর এভাবে ফুল বিক্রি বা টাকা চাইতে আসলে প্রায় সময়ই না বলে তাড়িয়ে দেই। কিন্তু মেয়েটাকে না বলিনি। জিজ্ঞেস করলাম বসবে? মেয়েটাও বসলো। নাম কি? কোথায় থাকো? এখানে একা এসেছো? উত্তর আসলো- আমার নাম সুমাইয়া। একা না, ঐ যে আমার আম্মু গাছের নিচে বসে আছে। আমাদের কোন বাসা নেই। রাতে ওভারব্রিজে থাকি। কিছু খেয়েছো? ‘হ, খাইছি। আচ্ছা আপা যাই। এই ফুলগুলো বেচতে হইবো।’ আচ্ছা যাও, আর এই টাকাটা নাও।‘ফুল নিবেন না?’ না। ‘আচ্ছা আপা যাই’।
আরো একদিন মিরপুর ১০ এ রাস্তা পারাপারের সময় হঠাৎ একটা বাচ্চা ছেলে জামা ধরে টান দিয়ে আমার সামনে হাত পেতেছে। কিন্তু কিছু বলছেনা শুধু তাকিয়ে আছে। প্রথমে মেজাজ খারাপ হয়ে গিয়েছিল জামা ধরে টান দেওয়াতে। কিন্তু বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে ঠান্ডা হয়ে গেলাম। পরনে শুধু একটা হাফ প্যান্ট পড়া। গায়ে প্রচুর ময়লা। চোখগুলো ছলছল করছে, মুখটা খুবই মায়াবি। মুহূর্তের জন্য একটু খারাপ লাগলো। কিন্তু ঐদিন তাড়া থাকায় বাচ্চাটাকে ১০ টাকা দিয়ে চলে গেছি। এভাবে প্রায়ই এমন অনেক বাচ্চা সামনে চলে আসে কিন্তু সবাইকে সাহায্য করা হয়ে ওঠেনা। এড়িয়ে চলে যাওয়া হয়।
বিভিন্ন সংস্থা ও গবেষণার তথ্যানুযায়ী, সারাদেশে প্রায় ১০ থেকে ১৫ লাখ পথশিশু রয়েছে; যার অর্ধেকই অবস্থান করছে রাজধানী ঢাকায়। আর এই পরিসংখ্যানের ৮৫ ভাগ পথশিশুই মাদকাসক্ত।
খোঁজ নিলে জানা যায়, এই পথশিশুদের নিয়ে কাজ করে এমন অনেক সরকারি-বেসরকারি সংগঠন রয়েছে। তাছাড়াও ব্যক্তি পর্যায়েও অনেকে পথশিশুদের নিয়ে কাজ করেন। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানও সাহায্য করে থাকে এই সংগঠনগুলোকে। কিন্তু এতে কি কোন টেকসই উপকার মিলছে? তাতে পথশিশুরা পাচ্ছে কি তাদের মৌলিক অধিকার? পাচ্ছে না। মিলছে না তেমন কোন উপকার। এভাবে যথাযথভাবে পুনর্বাসন না হওয়ায় তাদের আবার পথেই ফিরে যেতে হয়।
কুরসিয়া জামান প্রিতম
সাংবাদিক/শিক্ষার্থী
দি ডেইলি ট্রাইবুনাল/গ্রিন ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ