২৭শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ ❑ ১৪ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
১৭ই শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি ❑ শনিবার

ম্যান্ডেলা দিবসে কিংবদন্তী নেতার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন

অনলাইন ডেস্ক, অধিকরণ ডট কম

অধিকরণ অনলাইনের সর্বশেষ খবর পেতে গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি অনুসরণ করুন

বিজ্ঞাপন

রুহুল ইসলাম টিপু:

নেলসন রুলিহলাহলা ম্যান্ডেলা গণতন্ত্র সংগ্রামী কিংবদন্তী নেতা। বর্ণবাদ বিরোধী সংগ্রামের অগ্রদূত নেলসন ম্যান্ডেলা হিসেবে পরিচিত। রুলিহলাহলা এটি তাঁর গোত্রীয় নাম। নেলসন নামটি ইংরেজি থেকে এসেছ। এটি দিয়েছেন তাঁর স্কুল শিক্ষক। জন্ম ১৮ জুলাই ১৯১৮ সাল। আজ নেলসন ম্যান্ডেলা’র ১০৬ তম জন্ম দিন। জন্মস্থান সাউথ ইস্টার্ণ ক্যাপ অব সাউথ আফ্রিকার ছোট্ট গ্রাম। নাম ট্রান্সকেই। মায়ের নাম নোসেকেনি ফানি। বাবা গাডলি হেনরি মফাকানিয়াস্বা। তাঁর বাবা গ্রামের প্রধান এবং রয়েল ফ্যামেলি অব দি থিমবু উপজাতির সদস্য ছিলেন। ভাষা জোসা। উপজাতি গোত্রেই বেড়ে উঠেন ম্যান্ডেলা। তিনি দেখেছেন শ্বেতাঙ্গদের নিষ্ঠুর আক্রমাণাত্মক পরিবেশ। মানুষের নির্মম ভেদাভেদের অসাম্যের সংস্কৃতি।

বিজ্ঞাপন

ম্যান্ডেলা মেথোডিস্ট চার্চ স্কুলে লেখাপড়া করেন। আফ্রিকার উপজাতিতে বয়:জ্যৈষ্ঠদের সিদ্ধান্তে অনেকটা জোরপূর্বক বিয়েতে বসানোর প্রথা থাকলেও তিনি সেটা পরিত্যাগ করেছিলেন। ছাত্র ধর্মঘটের নেতৃত্ব দেওয়ার কারণে ১৯৪০ সালে হেয়ার ইউনিভার্সিটি কলেজ তাকে বহিস্কার করেছিল। তিনি উইওয়াটারস্ট্রান্ড ইউনিভার্সিটি থেকে ডিগ্রী গ্রহণ করেন। ১৯৪২ সালে ইউনিভার্সিটি অব সাউথ আফ্রিকা থেকে আইন বিষয়ে ডিগ্রী অর্জন করেন। ১৯৪৪ সালে ম্যান্ডেলা দক্ষিণ আফ্রিকার রাজনৈতিক দল আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস এ যোগ দেন। আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস এর মূল উদ্দেশ্য হলো কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও উন্নয়ন। বর্ণ ভেদে সকল মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। অল্প সময়ের মধ্যেই ম্যান্ডেলা এএনসি’র যুব লীগের নেতা হন। ১৯৫১ সালে তিনি লীগের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।

দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণ বৈষম্য নীতি, বর্ণবাদ নীতি যাকে ইংরেজিতে অঢ়ধৎঃযবরফ বলে। বর্ণ বৈষম্য একটি পলিসি যেটা শে^তাঙ্গ সংখ্যালঘু এবং অশে^তাঙ্গ সংখ্যাগুরুর মাঝে একটি সম্পর্ক। কর্তৃপক্ষের অনুমোদনপ্রাপ্ত বর্ণ পৃথকীকরণ পদ্ধতি যার মাধ্যমে সংখ্যাগুরু অশে^তাঙ্গরা রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিকসহ সকল বৈষম্যের শিকার। ১৯৫০ সালের পপুলেশন রেজিষ্ট্রেশন অ্যাক্ট অনুসারে- ১৯৬০ সাল থেকে বলা হলো এটি পৃথক উন্নয়ন পদ্ধতি। যার শ্রেণিকরণ করা হয় বান্টু যারা সকল অশে^তাঙ্গ এবং শে^তাঙ্গ। এখানে থাকবে অশে^তাঙ্গ ছাড়া অন্য সকল বর্ণের মানুষ। চতুর্থ তালিকায় আসে এশিয়ান বিশেষ করে ভারতীয় এবং পাকিস্তানীরা এতে যুক্ত।

১৯৫১ থেকে ১৯৬০ সাল ছিল দক্ষিণ আফ্রিকা এবং এএনসি’র জন্য খুবই কঠিন সময়। এ সময় বর্ণ বৈষম্য নীতির বিরুদ্ধে যুব কর্মীগণ এবং ম্যান্ডেলা শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ কর্মসূচির মধ্য দিয়ে আন্দোলন শুরু করেন। এতে কোন অগ্রগতি হয় না। বরং দক্ষিণ আফ্রিকার সরকার আরো হিংসাত্মকভাবে আন্দোলনকারীদের প্রতিরোধ করে। শান্তিপূর্ণভাবে বর্ণ বৈষম্য নীতি নির্মূলে ম্যান্ডেলার সব রকম প্রস্তুতিই ছিল। তিনি উপলব্ধি করেন অহিংস আন্দোলনে কোন ফলাফল বয়ে আনবে না। আন্দোলনের কৌশল পরিবর্তন করে ১৯৫২ সালে ম্যান্ডেলা’র নেতৃত্বে এএনসি ৯ মাস কারাবরণের প্রতিবাদ কর্মসূচি গ্রহণ করে। ১৯৫৬ সালে ম্যান্ডেলা এএনসি’র অন্যান্য নেতৃবৃন্দের সাথে গ্রেপ্তার হন। এ সময় অশে^তাঙ্গদের মুক্তভাবে দেশে চলাচলে বাধাদানের উপর একটি আইন পাস হয়।

১৯৬০ সালে আন্দোলন শারপেভিল পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে পুলিশ নিরস্ত্র জনগণের উপর গুলি বর্ষণ করে। ম্যান্ডেলা’র বিরুদ্ধে রাষ্ট্র বিরোধী অভিযোগ আনা হয়। তাদেরকে ১৯৬১ সালে অবরুদ্ধ করা হয়। একই সময় দক্ষিণ আফ্রিকার সরকার এএনসি দলকে নিষিদ্ধ করে। শারপেভিল শহর জোহানসবার্গ হতে দক্ষিণে ৫০ কিলোমিটার দূরে। এ সময় সরকার’কে আন্দোলনকারীরা বুঝিয়ে দেন অহিংস আন্দোলন শেষ। ২১ মার্চ ১৯৬০ সালের তান্ডব দেখেছে সারা বিশ^। এ দিবসকে দক্ষিণ আফ্রিকার মানবাধিকার দিবস বলা হয়। ১৯৬১ সালে বর্ণ বৈষম্য নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনকারীরা সেমি আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যান। গঠিত হয় অল আফ্রিকান ন্যাশনাল অ্যাকশন কাউন্সিল। ম্যান্ডেলা নির্বাচিত হন এর সম্মানিত সেক্রেটারি। পরবর্তীতে তিনি এটির প্রধান নির্বাচিত হন। এটি যুদ্ধ করে বর্ণ বৈষম্য নীতির বিরুদ্ধে।

বিজ্ঞাপন

১৯৬২ সালে পুনরায় ম্যান্ডেলা’কে গ্রেপ্তার করা হয়। তার ৫ বছরের জেল হয়। রাষ্ট্র বিরোধী অভিযোগে ম্যান্ডেলাকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেওয়া হয়। ২৭ বছর কারাভোগ করেন। বর্ণ বৈষম্য নীতির সরকারের নির্যাতন বেড়েই চলে। কারাগারে জনসাধারণের সাথে ম্যান্ডেলা’র আলোচনা নিষিদ্ধ করা হয়। যৎসামান্য কিছু ব্যক্তি দেখা করার সাক্ষাৎ পেতেন। এর মধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকা এবং সারা পৃথিবীতে তিনি আন্তর্জাতিকভাবে বর্ণ বৈষম্য নীতির প্রতিবাদকারীর প্রতীক হয়ে উঠেন। ১৯৭৬ সালের ২৬ জুন বিদেশি ভাষায় স্কুল শিক্ষা প্রচলনের প্রতিবাদ বিক্ষোভে গুলি চালালে শিশুসহ ৭ শত নিহত হয়। আহত হয় ৪ হাজার। এর ফলে দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদ বিরোধী সংগ্রাম তীব্রতর হয়।

১৯৮৮ সালে ম্যান্ডেলা খুব অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে যান। সুস্থ হওয়ার পর আবার কারাগারে। তবে কড়াকড়ির শর্তাবলি কিছুটা হলেও শিথিল ছিল। এ সময় ক্ষমতাসীন শ্বেতাঙ্গদের মধ্যে দ্ব›দ্ব তীব্রতর হয়। বিভিন্ন মহল হতে প্রতিবাদ উঠে। আন্তর্জাতিকভাবে চাপ বাড়তে থাকে বর্ণ বৈষম্য নীতির বিরুদ্ধে। দক্ষিণ আফ্রিকা বর্ণবাদী রাষ্ট্র হিসেবে একাকী হয়ে পড়ে। দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট এফ ডবিøউ ডি ক্লার্ক বিশ্ববাসীকে আশ্বস্থ করে জানান যে, ম্যান্ডেলা’কে ছেড়ে দিবেন। ১১ ফেব্রুয়ারি ১৯৯০ ম্যান্ডেলা কারাগার থেকে মুক্ত হন। পৃথিবী তাকে অভিনন্দন জানায়। স্বাগতম প্রিয় নেতা!

১৯৯১ সালে ম্যান্ডেলা এএনসি এর প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তার পার্টি রাজনীতি করার আইনী যোগ্যতা অর্জন করে। বর্ণ বিরোধী নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা এবং ডি ক্লার্ক উপলব্ধি করেন অশে^তাঙ্গ এবং শে^তাঙ্গ এর মিলন বড়ই প্রয়োজন। তারা গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটিয়েছেন। অবসান হলো বর্ণ বৈষম্য বিরোধী নীতি বা অঢ়ধৎঃযবরফ. ফলশ্রæতিতে ১৯৯১ সালে বহুদলীয় গণতন্ত্রের নতুন একটি অধ্যায় জন্ম হলো দক্ষিণ আফ্রিকায়। গণতান্ত্রিক দেশের বর্ণ, গোত্র, রং এর ভেদাভেদ তুলে দিয়ে সকল মানুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করে। ১৯৯২ সালে ম্যান্ডেলা এবং ডি ক্লার্ক দুই নেতা নতুন সংবিধান প্রণয়ন করেন। অবাধ ও মুক্ত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে এসেম্বলী গঠিত হয়। নতুন নির্বাচিত সরকার গঠিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত অস্থায়ী একটি সরকার গঠিত হয়। ২৭ এপ্রিল ১৯৯৪ সালে প্রথম অবাধ মুক্ত নির্বাচনে এএনসি ৬২ ভাগ ভোট পেয়ে ম্যান্ডেলা প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। জুন ১৯৯৯ সালে তিনি অবসরে যান। ম্যান্ডেলা বুরুন্ডির শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য মেডিয়েটরের দায়িত্ব পালন করেন; যেখানে গৃহ যুদ্ধে সহ¯্রাধিকের প্রাণহানি ঘটে। তিনি পৃথিবীর শান্তি প্রতিষ্ঠায় সকল সন্ত্রাসী ও আগ্রাসী কর্মকান্ডের বিরুদ্ধেও রুখে দাঁড়ান। ম্যান্ডেলা ১৯৯৩ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। নভেম্বর ২০০৯ এ জাতিসংঘ কর্তৃক শান্তির সংস্কৃতি এবং স্বাধীনতার অবদান স্বরূপ প্রতিবছর তার জন্মদিন ১৮ জুলাই এ মহান নেতার স্মরণে বিশ^ নেলসন ম্যান্ডেলা দিবস ঘোষণা করা হয়। নেলসন রুলিহলাহলা ম্যান্ডেলা ২০১৩ সালের ০৫ ডিসেম্বর দেহ ত্যাগ করেন।

বিজ্ঞাপন

প্রত্যেক মানুষের পরিবর্তনের সক্ষমতা রয়েছে। দায়িত্বশীলতার সাথে এ সক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যমে আমরা আমাদের সমাজ, রাষ্ট্র এবং পৃথিবীর পরিবর্তন ঘটাতে পারি। নেলসন ম্যান্ডেলা দিবসে এটিই হোক আমাদের অঙ্গীকার। তিনি ৬৭ বছর মানব কল্যাণে ব্যয় করেছেন। একজন মানবাধিকার আইনজীবী, সচেতন কারাভোগী, আন্তর্জাতিক শান্তির বাহক এবং গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট। আমরাও তো প্রতীকিভাবে ৬৭টি মিনিট অর্থ্যাৎ ১ ঘন্টা ৭ মিনিট ব্যয় করতে পারি নেলসন ম্যান্ডেলা’র উপর আলোকপাত করে। এটি নিয়ে যেতে পারি আমাদের সমাজে। দেশ পরিবর্তনের লক্ষ্যকে সামনে রেখে।

বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনের সামনের সারিতে ছিলেন তাঁর কন্যা জিন্দজি ম্যান্ডেলা। ম্যান্ডেলা বন্দী থাকার কারণে বাবার সাথে তার প্রথম দেখা হয় ১৫ বছর বয়সে। জিন্দজি ছিলেন বোন জেনানিসহ তিন কন্যার মধ্যে সবচেয়ে ছোট। সরকারের নিষেধাজ্ঞার কারণে মায়ের সাথেও নিয়মিত থাকা হতো না। লেখাপড়া করতে পারেন নি জন্মস্থান সোয়েটেতে। ১৩ জুলাই ২০২০ এ জোহানসবার্গে ম্যান্ডেলা’র কন্যা জিন্দজি ম্যান্ডেলা মৃত্যুবরণ করেন। তিনি ছিলেন ডেনমার্কে দক্ষিণ আফ্রিকার রাষ্ট্রদূত। পৃথিবী হারায় আরেক অসমাপ্ত কর্মের সহযাত্রীকে।

জাতিসংঘ ২০১৯ থেকে ২০২৮ কে নেলসন ম্যান্ডেলা শান্তির দশক ঘোষণা করে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার রজতজয়ন্তী ২৫ বর্ষের রাষ্ট্রীয় আয়োজনে তিনি আমাদের মাঝে সামিল হয়েছিলেন। আমরা বাংলাদেশবাসী মহান নেতা’র সান্নিধ্য পেয়ে গণতন্ত্রকে আরো সুসংহত এবং স্থায়ী মজবুত করার প্রত্যয় গ্রহণ করি। এ দশকের একজন মানুষ হিসেবে স্যালুট জানাই তার মানবতাবাদ, ক্ষমা প্রদর্শন এবং অসীম সহিষ্ণুতাকে। এতেই প্রতিষ্ঠিত হবে আগামীর শান্তিময় পৃথিবী। আমাদের প্রিয় নেতা অমর হোক!

বিশ^ ম্যান্ডেলা দিবসে কিংবদন্তী নেতার প্রতি সকল গণতান্ত্রীকামী মানুষের পক্ষে নিবেদন করছি গভীর শ্রদ্ধা।

রুহুল ইসলাম টিপু : একজন কলাম লেখক ও উন্নয়ন কর্মী।

বিজ্ঞাপন

সংবাদটি শেয়ার করুন

নিউজলেটার সাবসক্রাইব

জনপ্রিয়

আপনার জন্য আরো কিছু সংবাদ
সম্পর্কিত

পর্যটন ব্যবসা এগিয়ে নিতে নেপাল-বাংলাদেশ এলায়েন্স গঠন

কাঠমান্ডু (নেপাল) সংবাদদাতা নেপাল বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশীপ অ্যাসোসিয়েশন (এনবিএফএ) গতকাল সকালে...