২০শে মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ ❑ ৬ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
১১ই জিলকদ, ১৪৪৫ হিজরি ❑ সোমবার

এ বিজয় কেবল ফুটবলে নয়

অনলাইন ডেস্ক, অধিকরণ ডট কম

অধিকরণ অনলাইনের সর্বশেষ খবর পেতে গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি অনুসরণ করুন

বিজ্ঞাপন

স্বপ্না রেজা

ওরা ১১ জন নারী বাংলাদেশকে সম্মানজনক শীর্ষস্থানে নিয়ে গেল। সাফ ফুটবল চ্যাম্পিয়ন শিরোপা তুলে দিল বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষের ললাটে। কে পেরেছে আগে এমন করে শিরোপা পরাতে? পারেনি। দেশের অজপাড়াগাঁ থেকে উঠে আসা একেকজন বাঘিনী ওরা। সংসারের অভাব ও অসচ্ছলতা, সমাজের নানা প্রতিকূলতা ও প্রতিবন্ধকতা, ধর্মান্ধতা কোনো কিছুই ওদেরকে রুখতে পারেনি, বাঁধতে পারেনি। জীবনের জরাজীর্ণ ছবি ওদেরকে দুর্বল করেনি। অদম্য সাহস ও শক্তি নিয়ে ওরা এগিয়েছে।

বিজ্ঞাপন

এতটাই নীরবতায় ছিল ওদের সব আয়োজন ও প্রস্তুতি যে, ওদের সাফল্য ও কৃতিত্ব সূর্যের প্রখরতার চেয়েও বেশি হয়ে দেখা দিল আচমকা যেন বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি মানুষের মনে। বিস্মিত ও বিমোহিত হয়ে পড়ল সবাই। অসীম ভালো লাগা, উচ্ছ্বাস আর আনন্দে কমবেশি সবাই দিশেহারা। গোটা দেশ ভাসছে বিজয়ের আনন্দে। দেশের জন্য এমন বিজয় অর্জন, এমন প্রাপ্তি কজন এনে দিতে পেরেছে অতিসামান্য সুবিধা পেয়ে। পারেনি। জেনেছি, একবেলা খেয়ে, একবেলা উপোস থেকে চোখ মেলতে শেখাটাই যেন ওদের ব্রত ছিল। ওরা বাংলাদেশের জাতীয় নারী ফুটবল দলের খেলোয়াড়। যাদের নাম আমরা অনেকেই জানতাম না সাফ চ্যাম্পিয়ন শিরোপা বিজয়ের আগে। এখন ওদের নাম ধনী, গরিব, মন্ত্রী, আমলা, ব্যবসায়ী, শ্রমিক, দিনমজুর সবার মুখে মুখে, ঘরে ঘরে। এখন ওদের ছবিতে সয়লাব মিডিয়া, সোশ্যাল মিডিয়া। এসব কারো বিশেষ বিবেচনায় নয়, এসব ওদের যোগ্যতায়। ওদের কারণে বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা আরো একবার উড়ল। ওরা ইতিহাসের বিজয়ের সাক্ষী হয়ে থাকল। সাফ নারী টুর্নামেন্টে ওরা অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন। এটা কোনো সাধারণ ঘটনা নয়, অসাধারণ ঘটনা। অনেকের বিস্ময়, এও কি সম্ভব!

বিস্মিত হওয়ার কারণ অনেক। প্রথমত, এ দেশে এখনো ধর্মান্ধতা রয়েছে। নারীদের পুরুষের অধীনস্থ করে রাখা, পর্দার ভেতর রাখা, পর্দা করে চলার ফতোয়া রয়েছে সমাজে, শিক্ষা, মেধা, জ্ঞানে যতই নারী এগিয়ে যাক না কেন ও আয়-কর্মসংস্থানে নারীর অংশগ্রহণ যতই দেশকে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির দিকে নিয়ে যাক না কেন। সরকারপ্রধান নারীবান্ধব হলেও শিশুরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠ্যপুস্তকে যে কারিকুলাম, বিষয়াদি শিখছে তা মোটেও নারীবান্ধব হয়ে ওঠেনি। নারী ও ইতিহাসকে যেভাবে উপস্থাপন করা হয় তাতে নারীর প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টির সুযোগ থাকে না। যেমন, যৌননিপীড়ন ও সহিংসতা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য যে শিক্ষা পাঠ্যপুস্তকে দেয়া হয়েছিল তাও ছিল পরোক্ষভাবে নারীকে গৃহবন্দি করে রাখার শামিল। নিরাপত্তার প্রশ্নে তার অধিকার হরণ করে জীবনাচরণে উদ্বুদ্ধ করা আরেক ধরনের নিপীড়ন। অর্থাৎ ধর্মীয় উগ্রচিন্তার আগ্রাসনটা যেন নীরবে ও প্রকাশ্যে নারীর অধিকার হরণ করছিল। সাম্প্রতিক সময়ে পোশাক বিতর্কে নারীকে কোণঠাসা করে রাখার পাঁয়তারা বেশ দৃশ্যমান ছিল।

এই দৃশ্যমানতা শুধু ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানেই নয়, বিচারিক রায়েও শোনা গেছে, যা সাধারণ মানুষকে দারুণভাবে হতাশ করেছে এবং নারীর অধিকার হরণ করেছে। এমন একটি অবস্থায় জার্সি ও হাফপ্যান্ট পরে বাংলাদেশের নারীরা ফুটবল খেলবে, এই খেলার শুরুটা হবে মফস্বল এলাকার রক্ষণশীল প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে এবং এই খেলোয়াড়রাই একদিন আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট খেলে চ্যাম্পিয়ন তকমা ছিনিয়ে আনবে, এটা কিন্তু সহজ হিসাব নয়। দ্বিতীয়ত, আমাদের অভিজ্ঞতা বলে যেকোনো বিষয়ে ভালো ফলাফল বা অর্জনের জন্য সেক্ষেত্রে অনেক বিনিয়োগ করতে হয়, বিনিয়োগ করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। এই বিনিয়োগ হতে পারে টাকায়, শিক্ষা প্রদানে, উপযুক্ত পরিবেশে, নিরাপত্তায়, উপকরণে ইত্যাদিতে। সাফ ফুটবলে বিজয়ীদের জন্য বাফুফের অব্যাহত প্র্যাকটিস ও ক্যাম্প আয়োজন ছাড়া অন্য কিছুর সহায়তা ছিল কি না জানা নেই। তবে তারা বেতন বা সম্মানি হিসেবে যে অর্থ পেয়ে থাকত তা ছিল অতি নগণ্য এবং অবশ্যই তা পুরুষ খেলোয়াড়ের তুলনায় চরম বৈষম্যমূলক। নারী খেলোয়াড়রা যে সম্মানী বা ভাতা পেয়ে আসছে তাতে বোঝা যায় যে, তারা কতটা বৈষম্যের শিকার। প্রায় প্রতিটি খেলোয়াড় এতটাই অসচ্ছল পরিবারের যে, দরিদ্রতা তাদের মানসিক দুশ্চিন্তার কতটা নিত্যসঙ্গী তা সহজেই অনুমেয়। সোজা কথায়, আর্থিক ও সামাজিক এই নিরাপত্তাহীনতার মধ্য দিয়েই তারা তাদের বেস্ট পারফরম্যবান্স দেখাতে পেরেছেন এবং সেটা আন্তর্জাতিক পরিসরে। প্রচুর সুবিধাপ্রাপ্ত পুরুষ ও অন্য খেলোয়াড়দের সঙ্গে তাদের মূল পার্থক্য এখানেই। এই বিজয়ীদের জন্য আহামরি কোনো ব্যবস্থা বাফুফের থেকে করা হয়েছিল কি না সেটা কিন্তু কোথাও জানা যায়নি। আমরা বুঝতে পারিনি।

তৃতীয়ত, খেলোয়াড়দের উৎপত্তিস্থল ছিল অজপাড়াগাঁ ও পাহাড়ি অঞ্চল, যেখানে খেলাধুলার আধুনিক সুযোগসুবিধা প্রাপ্তির সম্ভাবনা কম। উপরন্তু রয়েছে পদে পদে বাধা। সাধারণত এমন বিরাট সাফল্যের নেপথ্যে এতটা সাদামাটা গল্প দেখা যায় না। এমন একটি অবস্থা থেকে খেলায় নিজেদেরকে অতি আধুনিক করে গড়ে তোলা অদম্য সাহস ও সাধনার বিষয়, যা তারা চর্চার মধ্য দিয়ে অর্জন করেছেন। তাদের মনোবল ছিল সব ধরনের সহায়তা প্রাপ্তির অনেক ঊর্ধ্বে। কী পেয়েছেন, কতটুকু পেয়েছেন কিংবা কতটুকু দরকার, এমন চিন্তাচেতনা তাদের ছিল না বিধায় তারা বিজয়ী হওয়ার সাধনা করতে পেরেছেন, খেলায় মনোনিবেশ করতে পেরেছেন। সেইসঙ্গে বলি, সংশ্লিষ্টদের ব্যর্থতা এখানেই যে অজপাড়াগাঁ ও পাহাড়ি অঞ্চল বলে এই খেলোয়াড়দের আর্থ-সামাজিক অবস্থা, পারিবারিক অবস্থার কথা জানার প্রয়োজন বোধ কেউ করেনি। এটাও কিন্তু এই খেলোয়াড়দের গতি রোধ করতে পারেনি, গতি কমিয়ে দিতে পারেনি। খেলোয়াড়দের এই প্রাপ্তিবিমুখতা সত্যিই বিরল। ইতঃপূর্বে দেখা যায়নি। চতুর্থত, এই দলের প্রায় প্রতিটি খেলোয়াড় পরিবারের সমর্থন ও শেষ সম্বল নিংড়ে আন্তর্জাতিক মানের সফল খেলোয়াড়ে পরিণত হয়েছে। পুঁজিবাদ ও সুযোগসুবিধাবাদ সমাজে যা কখনোই দৃশ্যমান হতে দেখা যায় না, যায়নি। পঞ্চমত, এটি এমন একটি দল যেখানে মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, চাকমা, গারো ধর্মাবলম্বী খেলোয়াড় রয়েছেন। ধর্মীয় সংখ্যালঘু বা সংখ্যাগরিষ্ঠতার কোনো ভেদাভেদ নেই, প্রশ্ন নেই। নেই শ্রেণিবৈষম্যের সীমারেখা। এখানে সবাই এক, একই ফ্রেমে বাঁধা। ওদের পরিচয়, ওরা বাংলাদেশি। এই নারী দল যেন বাংলাদেশের পবিত্র সংবিধানের প্রতিফলন। এই নারী দল বলে দেয়, এই দেশ ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী এক দেশ।

বিজ্ঞাপন

নারী দলের প্রধান কোচ গোলাম রাব্বানী ছোটন পিতৃতুল্য যত্নে মেয়েদেরকে দক্ষ করে গড়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পৌঁছে দিয়েছেন, সেও এক বিস্ময়! সুবিধাভোগের চলমান সংস্কৃতিতে তার একাগ্রতা, একনিষ্ঠতা, আন্তরিকতাও বিরল এই সমাজে। ছোটন সৃষ্টিকর্তার আশীর্বাদ বলব। নারীর জন্য কণ্টক এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীদের ফুটবল খেলোয়াড় বানানোর ধকল নিশ্চয়ই সামলাতে হয়েছে তাকে পদে পদে। শুনেছি, তাকেও ইভটিজিংয়ের শিকার হতে হয়েছে। তিনি দমেননি। বরং শত প্রতিকূলতার মাঝ থেকে সাহস ও শক্তি অর্জন করেছেন। এভাবেই তো এগিয়ে আসতে হবে সবাইকে।

এই বিজয় কেবল ফুটবলে নয়, এই বিজয় বিদ্যমান সামাজিক প্রতিবন্ধকতার বিরুদ্ধে, বৈষম্যের বিরুদ্ধেও, যা এই ছোট ছোট মেয়েরা তাদের নির্মল, সতেজ অদম্য শক্তি ও সাহসে অর্জন করেছেন। বিদ্যমান ও প্রচলিত পুরুষি মনোভাবকে তারা কশাঘাত করতে সক্ষম হয়েছেন। জার্সি ও হাফ প্যান্ট পরনে নারী বিজয়ীদের সবাইকে বরণ করে নিতে হয়েছে। কারণ, এই মেয়েরাই বাংলাদেশের পতাকাকে উচ্চতর স্থানে নিয়ে গেছেন। এখানে পোশাক নিয়ে বিতর্ক ওঠেনি। ইতঃপূর্বে বিজয়ে এয়ারপোর্ট থেকে তাদেরকে পাবলিক বাসে আনা হলে তারা ইভটিজিংয়ের শিকার হয়।

বাফুফে বা কেউ তাদেরকে সেইভাবে বরণ করে আনেনি। এবার ফাইনাল খেলার আগে খেলোয়াড় সানজিদা আক্তারের আবেগঘন এক ফেসবুকে পোস্টে ছাদখোলা বাসের কথাটা উল্লেখ হলে স্বয়ং ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী ছাদখোলা বাসে তাদেরকে বরণ করে নেওয়ার ঘোষণা দেন। আমরা দেখেছি, কত দ্রুততায় ছাদখোলা বাসের আয়োজন হয়েছে। নারী খেলোয়াড়দের সম্মানির বিষয়টিও উঠে এসেছে। এই বিজয়ে ধর্মনিরপেক্ষতারও বিজয় হয়েছে। সবচেয়ে বড় বিজয় ছিল, নারীর সক্ষমতার।

বিজ্ঞাপন

এতদিন অন্য দেশের চলচ্চিত্রে দেখেছি, নারীরা কীভাবে ছোট পরিসর থেকে বৃহত্তর পরিসরে পৌঁছে যায় অদম্য সাহস ও সাধনায়। আজ বাস্তবে দেখছি, আমাদের দেশেই সেই অভাবনীয়, অভূতপূর্ব ঘটনাটি ঘটেছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলের ছোট ছোট মেয়ের এই বিজয় যেন আরেক মুক্তিযুদ্ধের বিজয়। তারা তাদের সামর্থ্য ও সাহস নিয়ে সেই যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে। ভালোবাসা ও শুভকামনা এই বিজয়ীদের জন্য।

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও কলাম লেখক

বিজ্ঞাপন

সংবাদটি শেয়ার করুন

নিউজলেটার সাবসক্রাইব

জনপ্রিয়

আপনার জন্য আরো কিছু সংবাদ
সম্পর্কিত