মোঃ সাহিদুল ইসলাম:
শিক্ষা মানুষকে শিক্ষিত করে কিন্তু সর্বদা সুশিক্ষিত করতে পারে না। সুশিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার জন্য নৈতিকতা থাকাটা জরুরি। শিক্ষা একটি জাতি গঠনের প্রধান উপাদান। একটি শিক্ষিত জাতিই পারে পৃথিবীর বুকে জায়গা করে নিতে এবং পারে একটি নতুন সভ্যতার জন্ম দিতে। সেদিক থেকে পরিসংখ্যান দেখলে সাম্প্রতিক কালে আমাদের এগিয়ে থাকারই কথা, কেননা বিগত প্রায় ১০ বছরের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার পাসের হার ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। সহজেই প্রতীয়মান হয় জাতি হিসেবে শিক্ষিত হচ্ছি, কিন্তু সুশিক্ষিত কি হতে পারছি?
সমাজে নীতিবান ও সুশিক্ষিত মানুষের বড়ই প্রয়োজন।সুশিক্ষা ও নৈতিকতাসম্পন্ন মানুষ তৈরিতে পরিবারের বড় একটি ভূমিকা থাকে। এর পাশাপাশি সরকারেরও ভূমিকা রয়েছে। কারণ নৈতিকতাসম্পন্ন ব্যক্তিতে পরিণত হতে যে বিষয়গুলো এড়িয়ে চলা প্রয়োজন, তা আজও সমাজে প্রচলিত। যেকোনো শিশুর মানসিক ও দৈহিক বিকাশের জন্য প্রথম ও প্রধান বিদ্যালয় হচ্ছে তার পরিবার এবং মা–বাবা হচ্ছেন শিক্ষক–শিক্ষিকা। তাদের স্নেহ ভালবাসা আর জীবনাদর্শ পেয়েই বয়সে বেড়ে ওঠার পাশাপাশি একটি শিশু মানবিক ও নৈতিক গুণাবলিতে বৃদ্ধি পেতে থাকে।
শিশুদের জীবন একটি ক্ষূদ্র বীজের মতো। একটি বীজের মধ্যে সুপ্তাবস্থায় থাকে অঙ্কুর। সেই বীজ উর্বর মাটিতে রোপিত হলে, অনুকুল পরিবেশ ও পরিচর্যা পেলে ক্রমান্বয়ে বিশাল বৃক্ষে পরিণত হয়। তেমনি একটি মানবশিশু জন্মগ্রহণ করে অপার সম্ভাবনা নিয়ে। সেই সম্ভাবনা বাস্তবরূপে পরিণত হয় শুভাকাঙ্ক্ষী গুরুজনদের প্রতিপালন, পরিচর্যা আর ব্যক্তির নিজ সাধনার গুণে।
মা বাবার এই অকুণ্ঠ স্নেহ ভালোবাসার জন্যই শিশুর মধ্যে সার্বিক মূল্যবোধের বিকাশ ঘটতে শুরু করে।
দেশকে একটি শিক্ষিত জাতি উপহার দিতে হলে সুশিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। সুশিক্ষায় ধর্মীয় মূল্যবোধ ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতিফলন থাকতে হবে। সুশিক্ষার মাধ্যমে মানবতা, অসাম্প্রদায়িকতা ও উদারতা শেখার সংস্কৃতি প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে ফিরিয়ে আনতে পারলে দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হবে।
স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, ‘যে ব্যবস্থার দ্বারা ইচ্ছাশক্তির বেগ নিজের আয়ত্তাধীন ও সফলকাম হয়, তাহাই শিক্ষা।’ ব্যক্তিজীবনে শিক্ষা গ্রহণের ভিন্নতা রয়েছে। মানুষ পারিবারিক, সামাজিক, প্রকৃতিগত ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শিক্ষালাভ করে থাকে। সাধারণভাবে শিক্ষা বলতে কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে জ্ঞানার্জনের জন্য একটি নির্দিষ্ট মেয়াদের কার্যক্রমকে বোঝায়। বর্তমানে শিক্ষার মূল হাতিয়ার হচ্ছে সনদপত্র অর্জন করা।
পরীক্ষা মানে একটি মান। এই মান এর একটি পাশে থাকবে ফেল আর একটি পাশে পাশ। কিন্তু এখন এই মানটিকে এমনভাবে সহজলভ্য করা হয়েছে যে এই পরীক্ষা হচ্ছে পাশ করানোর পরীক্ষা যেখানে ফেল নামক কিছুই থাকবে না।
এ সম্পর্কে প্রফেসর আব্দুল্লাহ আবু সায়েদ বলেন পরীক্ষা গ্রহণের লক্ষ্যই হলো ফেল করানো, তাতে যারা পাশ করে তাদের মান সঠিকভাবে যাচাই হয়। পরীক্ষা পদ্ধতি সহজ করে পাশের হার বাড়ালে অযোগ্য ছাত্র পাশ করবে, তাতে পরীক্ষার আর কোনো মূল্য থাকবে না। তিনি আরো আরো বলেন আমাদের শিক্ষার মান এখন নামতে নামতে এতই নিচে নেমেছে যে আর নিচে নামা সম্ভব নয়। এখান থেকে উপরের দিকেই যেতে হবে নিচে আর জায়গা নেই।
প্রশ্ন হলো এই বিশাল অঙ্কের ছাত্র–ছাত্রীরা কোথায় যাবে এরপর? প্রশ্ন জটিল হলেও উত্তর অনেক সহজ আমাদের এই দেশে। একেবারে ব্যাঙের ছাতার মত গড়ে উঠেছে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়। যেখানে শুধুমাত্র টাকার বিনিময়ে ডিগ্রী দিয়ে দেয়া হচ্ছে অনায়াসেই। গ্রাম থেকে এসে এভাবেই প্রতারিত হচ্ছে অনেক শিক্ষার্থী।
আমাদের উচ্চ শিক্ষা আজকে প্রশ্নের সম্মুখীন। পাবলিক ইউনিভার্সিটি নতুন হয়েছে অনেকগুলো কিন্তু সেগুলোর সংখ্যা এবং মান আরো বাড়াতে হবে। এবং হাতে গোনা দশটি ইউনিভার্সিটি ছাড়া বাকি প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিগুলোর অবস্থা খুবই জঘন্য। কিন্তু ঠিকই দেখা যাচ্ছে চার বছরের মধ্যে ডিগ্রী দিয়ে দিচ্ছে। আর অন্য দিকে আছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় যার অধীনে কয়েক লক্ষ্য ছাত্র ছাত্রী পড়াশুনা করছে , তার মান উন্নয়নের দিকেও কোনো খেয়াল নেই সরকারের। অনেক বার বলা হলো বিভাগ অনুযায়ী ভাগ করে দেয়া হোক জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে। তাতে করে এর মান এবং সেবা দুটোই বাড়বে কিন্তু নানা জটিলতায় সেটাও সম্ভব হলো না।
এভাবে কী পাব আমরা? হয়ত শিক্ষার হার বাড়বে কিন্তু আমরা শিক্ষিত মানুষ পাব না। দেশ হারাবে তার প্রাণশক্তি।তাই আধুনিক শিক্ষা নীতি প্রণয়ন আজ সময়ের দাবি। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর গবেষণা কাজে মনোনিবেশ খুবই প্রয়োজন। নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দেয়া বন্ধ করতে হবে, পুরনো গুলোর মান উন্নয়নে মনোযোগী হতে হবে।
সুশিক্ষা বলতে সেই প্রকৃত শিক্ষা কে বোঝায় যা মানুষ বাস্তব ক্ষেত্রে এর পজিটিভ দিক গুলোর প্রয়োগ ঘটাতে পারে। অর্থাৎ আপনি বইয়ে পড়েছেন সত্য কথা বলতে হবে , ভাল কাজ করতে হবে। এগুলো আপনি বাস্তবে প্রয়োগ দেখান আপনি সুশিক্ষিত।
আর পজিটিভ দিক উল্লেখ করার কারণ আপনি যা শিখবেন, তার অপপ্রয়োগ সুশিক্ষা হতে পারে না। তাই আপনি সফটওয়ার বানানো শিখেছেন তা বাস্তব ক্ষেতে মানব জাতির উপকারে কাজে লাগান এটি সুশিক্ষার উদারহণ।
মানুষ কেবল চোখ দিয়েই দেখেনা, এর পেছনে রয়েছে তার সক্রিয় মন ও মগজ। রয়েছে তার একটা দৃষ্টিভংগি ও মতামত। জীবনের একটা উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য আছে তার। সমস্যাবলী নিয়ে চিন্তা ভাবনা করার একটা প্রক্রিয়া তার আছে। মানুষ যা কিছু দেখে, শুনে এবং জানে, সেটাকে সে নিজের অভ্যন্তরীণ মৌলিক চিন্তা ও ধ্যান ধারণার সাথে সামঞ্জস্যশীল করে নেয়। অতপর সেই চিন্তা ও ধ্যান ধারণার ভিত্তিতেই তার জীবন পদ্ধতি গড়ে উঠে। এই জীবন পদ্ধতিই হলো সংস্কৃতি। যে জাতি একটা স্বতন্ত্র সংস্কৃতি, আকিদা বিশ্বাস ও উদ্দেশ্য লক্ষ্যর অধিকারী এবং যাদের রয়েছে নিজস্ব জীবনাদর্শ, তাদেরকে অব্যশ্যি তাদের নতুন প্রজন্মকে সেই স্বতন্ত্র সংস্কৃতি, আকিদা বিশ্বাস, উদ্দেশ্য, লক্ষ্য ও জীবনাদর্শের রক্ষণাবেক্ষণ এবং তার বিকাশ ও উন্নয়নের যোগ্য করে গড়ে তোলা কর্তব্য। আর সে উদ্দেশ্যকে কেন্দ্র করেই গড়ে তুলতে হবে তাদের শিক্ষা ব্যবস্থা।
পূর্ণাঙ্গ মানুষের আত্ম প্রকাশের জন্যে যেসব গুনাবলী নিয়ে শিক্ষার্থী এ পৃথিবীতে আগমন করেছে, শিক্ষার উদ্দেশ্য হবে সেসব গুনাবলীর যথাযথ বিকাশ সাধন। শিশুর সামগ্রিক বিকাশই শিক্ষার উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। আর মানুষের শেষ লক্ষ্য হবে সৃষ্টিকর্তার সান্নিধ্যে সুখ লাভ করা। জ্যাক রুশোর মতে : সুঅভ্যাস গড়ে তোলাই শিক্ষার উদ্দেশ্য।
আমাদের শুধু শিক্ষিত হলেই চলবে না, আমাদের সুশিক্ষিত হতে হবে, হতে হবে ভাল মানুষ।
লেখকঃ সাংবাদিক, সহকারি সম্পাদক, ডেইলি ট্রাইবুনাল