২০শে মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ ❑ ৬ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
১১ই জিলকদ, ১৪৪৫ হিজরি ❑ সোমবার

নিতা’র প্রেম

অনলাইন ডেস্ক, অধিকরণ ডট কম

অধিকরণ অনলাইনের সর্বশেষ খবর পেতে গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি অনুসরণ করুন

বিজ্ঞাপন

রুহুল ইসলাম টিপু:

নিতা ভেবেছিল। আজ অনির চিঠি আসবে। ডাক পিওন পাশের বাসার দিয়েছেন। নিতার চিঠি ছিল না। তাই নিতার মন খারাপ। অনির নিকট হতে সপ্তাহে কমপক্ষে দু’টি চিঠি পায় নিতা। কখনও বেশিও আসে। সপ্তাহে পাঁচটি চিঠি পেয়েছে বেশ কয়েকবার। এটিও নিতার মনে আছে। এ চিঠিগুলো নিতার প্রাণ। অনির চিঠি’র মধ্যে থাকে বিচিত্র কর্মের ফিরিস্তি। কোথায় গিয়েছে, কি করেছে, কার সাথে দেখা হলো, নতুন বন্ধু, নানাবিধ বিষয়। নিতা’র এসব পড়তে ভালো লাগে। নিতা পড়ে আর ভাবে, সে তো অনি’র সাথেই আছে। অনি’র কর্মের মধ্যে ঢুকে পড়ে নিতা। অনি লিখতে পারে। যেখানেই যাবে নিতাকে সে অভিজ্ঞতা জানাবে। অনির কাজ এবং নিতা’কে লিখা এও এক অনন্য সৃষ্টি। চট করে লিখতে পারার গুণটি অনি বেশ রপ্ত করে ফেলেছে। নিতা অনির চিঠি পড়ে। শুধু প্রয়োজনীয় অংশের উত্তর দিবে। কিছু প্রশ্ন করবে। অনি’র চিঠি পড়তে পড়তে নিতাও তার মতো করে বিষদ লেখার অনুশীলন শুরু করেছে। নিতা’র চিঠিতে থাকে আবেগ। অনির চিঠিতে থাকে বর্ণনা এবং দৃশ্যপটে ভরপুর। তিন বছর পার হলো। অনি এবং নিতার চিঠি আসা যাওয়া চলছে। বড় মধুর সম্পর্ক। চিঠি বন্ধু। অনি এবং নিতা’র চিঠি বন্ধুর সূত্র পত্র মিতালী নয়।

বিজ্ঞাপন

বছর তিনেক পূর্বে তাদের দেখা হয়েছিল। একটি পাঠাগার আয়োজিত দেশব্যাপী রচনা প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণীর অনুষ্ঠান এবং সাহিত্য আসর। পাঠাগারে দেশের বরেণ্য সাহিত্যিক, সাংবাদিক, লোক-গবেষক এবং লেখক এর সমাবেশ ঘটেছিল। অনি আয়োজকদের পক্ষের একজন কর্মী। নিতা পুরস্কার গ্রহণ করতে এসেছে ময়মনসিংহ হতে। সাথে নিতা’র বাবা। পাঠাগারটি মানিকগঞ্জ শহরের বাইরে। নদী পাড় এবং রিক্সা মিলে ঘন্টা খানিকের পথ। অনন্য সুন্দর এক গ্রাম। পাঠাগার লাগোয়া সবুজ শ্যামল খেলার মাঠ। গ্রামের মাঝে রাস্তার সাথে একটি ছোট্ট খাল; মিশেছে বড় আরেকটি খালে; গন্তব্য কালিগঙ্গা নদী। শীতের সকাল কুয়াশা’র চাদরে ঢাকা ফসলের মাঠ। খালে পানি নেই। গ্রামের ভিতর বিভিন্ন পাড়ায় যাতায়াতে কয়েকটি সাঁকো দাঁড়িয়ে আছে। বর্ষা’কে মনে করিয়ে দেয়। বর্ষায় খালের ¯্রাতধারা। চারদিকে পানি আর পানি। নৌকা-ই প্রধান বাহন। এ সময় পানি নেই। অনি’র উপর দায়িত্ব পড়েছে; অংশগ্রহণকারীদের আপ্যায়ন এবং অনুষ্ঠানস্থলে স্বাগত জানাতে সহায়তা করা। সাহিত্য সভা’কে কেন্দ্র করে গ্রামে চলছে সাজ সাজ ভাব। এটি এখন এ গ্রামের বাৎসরিক উৎসবে রূপ নিয়েছে। অনি বেশ অস্বস্তি বোধ করে। আয়োজক পাঠাগারের বড় ভাই’রা তাকে এ কর্মটি না দিলেও পারতেন। বিশেষ করে অপরিচিত নারীদের স্বাগত জানানো, আপ্যায়ন এবং মূল মে হাজির করানো। উত্তর পাড়া’র পিডিবি’র প্রকৌশলীর বাড়ি। সেখানে শীতকালীন পিঠা এবং সকালের নাস্তা পর্ব শেষে যেতে হবে পাঠাগার চত্বরে। রঙিন কাগজ দিয়ে সাজানো পথ। অনি’কে তাড়া দিচ্ছে দ্রæত নাস্তা শেষ করে সকলকে নিয়ে আসরের প্যান্ডেলে যেতে হবে।

নিতা বলল, চলুন আসরের দিকে যাই। অনি এবং নিতা’র নাম পরিচয় ঘটে নাস্তার সময়। প্রত্যুত্তরে অনি জানাল, আসুন আমার সাথে। নিতা’র বাবা অতিথিদের সাথে পূর্বেই অনুষ্ঠানস্থলে চলে যান। অতীব রূপসী, হলদে এবং লালের মিশ্রণের পোশাকে নিতা ছিল অপরূপ। অনি’র আড়ষ্টতা তেমন না কাটলেও এক ধরনের গর্ব অনুভূত হয়। সুন্দরী নারীর সাথে পথ চলা; এ এক অন্য রকম রোমা কর মুহূর্ত। দুই প্রান্তের মানবী ও মানব এর যাত্রা। এ আয়োজনের পর হতেই চিঠি আসে চিঠি যায়। তাদের মধ্যে জানা জানি চেনা ঘনিষ্ঠতাও বেড়ে যায়। চিঠি যোগাযোগে নাম পরিবর্তন করে তারা নিতা এবং অনি’তে বেশী সাচ্ছন্দ্য। এটি তাদের নিজস্ব আবিষ্কার। অনি নিতা’কে এবং নিতা অনি’কে পেয়েছে। বাবা মা’য়ের দেওয়া নামে কেমন যেন বেমানান তাদের উভয়ের মধ্যে। নিতা’র মধ্যে অনি ঢুকে সমন্বিত শব্দ অনিতা। তিন অক্ষরের মাঝে দুই মেরুর মিলন। মধুময় সম্পর্ক। চিঠিতে একে অপরের নিকট পাওয়া এবং রাখার অঙ্গীকারে তারা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।

সময় গড়িয়ে যায়। নিতা’দের পরিবার ময়মনসিংহ থেকে চলে আসে কুমিল্লায়। নিতা এখন ভিক্টোরিয়া কলেজ, রানীর দিঘির পাড় এলাকার পূর্ব পূরুষের বাড়িতে বসবাস করে। অনি’কে কুমিল্লায় আসার আমন্ত্রণ জানায় নিতা। অনি’র সময় ব্যস্ততায় ভরা। ভুলেই গিয়েছে নিতা’র চেহারা। বছর পাঁচেক পূর্বের এক ঝলক দেখে ঠিক মনে করতে পারছে না নিতা’কে। কাছে এলে নিতা’কে চিনতে অসুবিধা হবে না ঠিক। তবে এতো নিকটতম ভালোবাসার মানুষের চেহারা ভুলে যাওয়া; এক ধরনের অপরাধবোধ অনি’কে যন্ত্রণা দেয়। নিতা’র কোন ছবিও অনি’র নিকট নেই। পাঠাগারের সাহিত্য আয়োজনের ছবিগুলোও বড় ভাইদের নিকট থেকে নেওয়া বা দেখা কোনটিই ঘটেনি অনি’র।

নিতা’রা চার বোন। নিতা বড়। স্কুল হতে লেখালেখি করার চর্চা। এখন স্থানীয় একটি পত্রিকা’র মাসিক নারী বিষয়ক পাতা তার সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়। পড়াশুনার পাশে পত্রিকার সাথে নিতা’র নিবিড় সম্পর্ক। দেশ ও সমাজ পরিবর্তনের একজন অগ্রগামী মানুষ। এসব কর্ম নিতা’কে মহিমান্বিত করে। অনি’র ভালোলাগাও বেড়ে যায় বহুগুণে। তার নিতা এগিয়ে যাচ্ছে দেশ ও বাঙলা সাহিত্য’কে সাথে নিয়ে। অনি নিতা’র আমন্ত্রণ উপেক্ষা করতে পারে না।

বিজ্ঞাপন

ঠিক হলো মে মাসের ১০ তারিখ অনি কুমিল্লায় যাবে। শহরে নিতা’র পত্রিকা অফিসে। সেখানে নিতা থাকবে। এরপর নিতা বাসায় নিয়ে যাবে। মেঘনায় ব্রীজ নির্মাণ চলছে। সায়েদাবাদ থেকে বাসে শাসনগাছা কুমিল্লা। মাঝে ফেরি। সময় ৪ থেকে ৫ ঘন্টা। আবার ফিরে আসা। একই সময় লাগবে। মাঝে পাওয়া যাবে ক্ষণিকের দেখা। অনেকদিন পূর্বে পাঠাগারের গ্রামের পথে হাঁটার স্মৃতি। পুনরায় আজ দেখা হবে। সেটিও খুব বেশি সময়ের জন্য নয়। অনি পত্রিকা অফিসে ঢুকে। সময় তখন ১১ টা বজে। একটি ছাপাখানা। দুই রুম। একদিকে মেশিন এবং ছাপাখানার সরঞ্জামাদি। অন্যটির এক পাশে ছাপাখানার অফিস। অন্য পাশে পত্রিকার অফিস। বসার জায়গা খারাপ নয়। পত্রিকার অফিসের আদলে ব্যবস্থা রয়েছে। তবে পরিসর তেমন বড় নয়। অফিসটি দোতলায় অবস্থিত। অফিসে মাত্র একজন লোক বসা। তাকে জিজ্ঞেস করতেই বলেন, আপা আসেনটি। ফোনে জেনে নিন। আপা আসবেন কি-না।অনি পত্রিকা অফিসের ফোনের সহায়তা চায়। লোকটি দেখালেন, তাদের ফোন তালাবদ্ধ। ল্যান্ড ফোন সব জায়গায় পাওয়া যায় না। অনি এ শহরে একদম নতুন। কিছুই চিনে না। এতদূর এসে দেখা হবে না; তার নিতার সাথে। এটি মানতে নারাজ। তবে হতাশাও ভর করে। আশা আকাঙ্খা স্বপ্ন মাটিতে মিশে যাবে। নিতা’দের বাড়ি চিনেও না অনি। পত্রের যোগাযোগ। চিঠির পরিচয়ে ভালোবাসা মানুষের নিকট যাওয়া। আবার বিপদেই পড়ে কি-না। নানাবিধ ভাবনায় অনি দিশেহারা। অনি তবে নিতাদের বাড়ির ফোন নম্বর জানে। এটিই অনি’র শেষ ভরসা।

পত্রিকা অফিস থেকে বের হয়ে অনি পুলিশের একটি ব্যারাকে ঢুকে পড়ে। সেখানে স্থানীয় কলের জন্য অনি এক কর্মকর্তা’কে অনুরোধ করে। অনুরোধে লাভ হয়। তিনি একটি মাত্র কল করার জন্য সুযোগ দেন। অনি নিতা’দের বাসার নম্বরে কল করে। অপর পাশ থেকে রিসিভার তুলে পুরুষ কন্ঠ হ্যালো বলেন। অনি ভয় পেয়ে যায়। অনি নিজের পরিচয় দিয়ে নিতা’কে চায়। ভদ্রলোক বলেন, তিনি টেলিফোনের লোক। লাইন নষ্ট। ঠিক করতে এসেছেন। তিনি অনি’কে জানান আপনি এক ঘন্টা পর কল করুন। তখন ঐ নম্বরের বাড়ির লোক ফোন ধরবেন। এখন সম্ভব নয়। অনি জ্ঞান হারানোর মতো অবস্থা। আরো এক ঘন্টা। আবার কে তাকে ফোন করতে দিবে। পুলিশ ভাইকে বলে একটি কল করার সুযোগ দিয়েছেন। আবার কি পুলিশ ভাই সুযোগ দিবেন? বিকল্প আর কোন পথ না পেয়ে এক ঘন্টা অপেক্ষার পর অনি আবার ফোন করে। এবার নিতা’র কণ্ঠ পাওয়া যায়। ভীষণ খুশি অনি। অনি এই শহরে। নিতা বিশ্বাসই করতে পারছে না। অনি’কে বলে, এক্ষুণি সে আসছে। পত্রিকার অফিসে অপেক্ষা করতে বলে ফোন ছেড়ে দেয়।

অপেক্ষার পালা আর শেষ হয় না অনির। অবশেষে চলে আসে কাঙ্খিত ভালোবাসা’র মানুষ। এসেই বলে, আমি নিতা নই। নিতা’র ছোট বোন। আপা আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন। আমার সাথে যেতে বলেছেন। হায় কপাল, অনির। কোনোভাবেই দেখা মিলছে না নিতা’র। দীর্ঘ প্রতীক্ষা, পথ এবং বাধা যেন শেষই হচ্ছে না।

বিজ্ঞাপন

আমার সাথে রিক্সায় বসতে আপনার আপত্তি নেই তো, কথাগুলো নিতা’র ছোট বোন দিনা’র। অনি’র কোন কিছুতেই আর আপত্তি নেই। শুধু নিতা’র সাথে দেখা হলেই চলবে। ভেবেই উঠে বসে রিক্সায়। ভাইয়া, আমাদের বাড়ি শহরের একটু বাইরে। আমি কয়েকটি কাজ করেই আপনাকে নিয়ে যাবো। অনি ভাবে আরো দেরি। আরো প্রতীক্ষা। আরো অপেক্ষা। আর বোধ হয় দেখা হবে না নিতার সাথে। এ ভাবনা এবং দেখা হওয়ার স্বপ্নে বিভোর অনি স্তব্ধ হয়ে যায়।

দিনা নিয়ে যায় ক্যাসেটের দোকানে। বাছাইকরা গান রেকর্ডিং এর ক্যাসেট নিবে। রিসিপ্ট নিয়ে আসেনি। লাগিয়ে দিল দোকানী’র সাথে তর্ক। অনেকগুলো ক্যাসেট খুঁজে পাওয়া গেল দিনা’র রেকর্ডিং ক্যাসেট। এরপর ফুজি ফিল্ম এ ছবি প্রিন্ট এর অর্ডার ছিল। সেটিও দিনা গ্রহণ করে। এরপর টেলারিং শপ এ জামা কাপড় নিবে। হায়রে কপাল। কখন যাবে। কখন আসবে। কখন দেখা হবে। এখানেও দিনা রিসিপ্ট ছাড়া ছবি ক্যাসেট পোশাক নিচ্ছে। অনি দেখছে। আর কপাল চাপড়াচ্ছে। তবে তার হাসিও পাচ্ছে দিনা’র কর্মকান্ড দেখে। অন্যদিকে অনি’র অন্তরাত্মা কেঁদে যাচ্ছে। এই বুঝি আর দেখা হবে না নিতা’র সাথে।

অবশেষে দুপুর গড়িয়ে তাদের বাড়ির সামনে রিক্সা থামে। অনি নেমে আসে। বসার ঘর খোলাই ছিল। নিতা দাঁড়িয়ে আছে পর্দার মাঝখানে। ঘরে ঢুকেই মুখোমুখি বসা। অনি তাকিয়ে আছে। চোখ নিচু করে। লজ্জা, ভয়, উৎকন্ঠা এবং এবং এশরাশ ক্লান্তি নিয়ে। চোখ তুলেই অনি দেখে। মৃদু হাচ্ছে নিতা। এ হাসি এবং চোখাচোখি বলে দেয়। নিতা এবং অনি’র গভীর নিগুঢ়তম ভালোবাসা।

লেখক : উন্নয়ন কর্মী; সাধারন সম্পাদক- টুগেদার ফর দি হেলপলেস পিপল (টিএইচপি)।

বিজ্ঞাপন

সংবাদটি শেয়ার করুন

নিউজলেটার সাবসক্রাইব

জনপ্রিয়

আপনার জন্য আরো কিছু সংবাদ
সম্পর্কিত