২৮শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ ❑ ১৫ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
১৮ই শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি ❑ রবিবার

পল্লী বিদ্যুৎ লাইনম্যান ক্রুদের দাবি এবং শ্রমিকের মানবাধিকার

অনলাইন ডেস্ক, অধিকরণ ডট কম

অধিকরণ অনলাইনের সর্বশেষ খবর পেতে গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি অনুসরণ করুন

বিজ্ঞাপন

রুহুল ইসলাম টিপু:

মানবাধিকার মানুষের জন্মগত অধিকার। এটি প্রাকৃতিক আইনের অংশ। সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার ধারা-২৩ এ বলা হয়েছে। প্রত্যেকেরই কাজ করার, অবাধে চাকুরি নির্বাচনের, কাজের ন্যায্য ও অনুকূল অবস্থা লাভের এবং বেকারত্ব থেকে রক্ষিত হবার অধিকার রয়েছে। কোন বৈষম্য ব্যতিরেকে সমান কাজের জন্য সমান বেতন পাওয়ার অধিকার রয়েছে। প্রত্যেক কর্মীর তার নিজের ও পরিবারের মানবিক মর্যাদা রক্ষার নিশ্চয়তা দিতে সক্ষম এমন ন্যায্য ও অনুকূল পারিশ্রমিক এবং প্রয়োজনবোধে সেই সঙ্গে সামাজিক সংরক্ষণের জন্য ব্যবস্থাদি লাভের অধিকার রয়েছে। প্রত্যেকেরই নিজ স্বার্থ রক্ষার্থে শ্রমিক ইউনিয়ন গঠন ও এতে যোগদানের অধিকার রয়েছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৪ অনুচ্ছেদটি শ্রমিক শ্রেণির স্বার্থের রক্ষা কবচ। সকল প্রকার জবরদস্তি শ্রম নিষিদ্ধ। এই বিধান কোনভাবে লঙ্ঘিত হলে তা আইনত: দন্ডনীয় অপরাধ বলে গণ্য হবে। বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা যাদের হাতে তারা হলেন- কৃষক, শ্রমিক, মজুর, ব্যবসায়ী, শিল্প মালিক, টেশনিশিয়ান, ড্রাইভার, মিস্ত্রী, কামার, কুমার, জেলে, বেদে, মুচি, ঋষি, ধোপা, তাঁতি, কাসারু, শাখারি, স্বর্ণকার, মাঝি, ঘরামি, কাহার, করাতি, পাতিয়ালসহ সকল শ্রেণি- পেশা ও নৃ-গোষ্ঠীর মানুষ। এরাই বাংলাদেশের সম্পদ ও প্রাণশক্তি।

বিজ্ঞাপন

কাঁদো, প্রিয় দেশ। কাঁদো মুক্তিদাতা মুজিবের জন্য। তাঁর সেই পরিচয়টাই ইতিহাসে অমর হবে। কাঁদো তাঁর সহমৃতা সাধ্বী সহধর্মিণীর জন্যেও, বালক পুত্রের জন্যও। কাঁদো, কাঁদো, প্রিয় দেশ। আগষ্ট এলে আমরা বেশি শোকাভিভূত হয়ে পড়ি। মনন ধ্যান চিন্তায় বেদনা বিধুঁর আগষ্ট নিয়ে ভাবি। শোকের কথা বলি। বঙ্গবন্ধু’র আদর্শের গভীরে যেতে চাই। তাঁর রাজনৈতিক দর্শন। জীবনালেখ্য নিয়ে অনুশীলন চর্চা করতে আগ্রহী। বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর পরিবারের অধিকাংশ সদস্যের মূখগুলো ভেসে উঠে। ঠিক এমনি এক সময়- ১৩ আগষ্ট হতে টানা বৃহস্পতিবার ১৭ আগষ্ট পর্যন্ত প্রায় ৫ হাজার পল্লী বিদ্যুতের লাইন ম্যান ক্রুদের কর্মবিরতি‘র কর্মসূচি দেখি। তাঁরা এসেছেন সারা দেশ থেকে। অবস্থান করেন বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়তন বোর্ড এর সম্মুখ রাস্তায়। মূখে এবং ব্যানারে লেখাও ছিল বঙ্গবন্ধু‘র বাংলায় বৈষম্যের ঠাই নাই। বাংলাদেশের স্থপিত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সারা জীবন মেহনতি মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করেছন। আমি এমন একটা নীতিনির্ধারণ করতে চাই যাতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কার্যকরী নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনায় অংশ নিতে পারে। শ্রমিক-কর্মচারীদের সর্বদা মালিকের সাথে বিরোধিতায় লিপ্ত থাকতে হবে না।- বঙ্গবন্ধু‘র কথা।

বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বয়স ৫২ বছর। শ্রমিক নিয়োগ, মালিক ও শ্রমিকের মধ্যে সম্পর্ক, সর্বনি¤œ মজুরীর হার নির্ধারণ, মজুরী পরিশোধ, কার্যকালে দুর্ঘটনাজনিত কারণে শ্রমিকের জখমের জন্য ক্ষতিপূরণ, ট্রেড ইউনিয়ন গঠন, শিল্প বিরোধ উত্থাপন ও নিস্পত্তি, শ্রমিকের স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা, কল্যাণ ও চাকুরির অবস্থা ও পরিবেশ এবং শিক্ষাধীনতা ও সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি সম্পর্কে সকল আইনের সংশোধন ও সংহতকরণকল্পে প্রণীত আইন হচ্ছে শ্রম আইন। এটি প্রণীত হয় ২০০৬ সালে। এ বছর ২০২৩ হচ্ছে- বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের টানা তিন মেয়াদের শাসনামলের শেষ বছর। নির্বাচনী বছর এটি। শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইতোপুর্বে ১৯৯৬ সালে সরকার গঠন করেছিলেন। এ মেয়াদ মিলে শেখ হাসিনা চার বার বাংলাদেশ সরকার পরিচালনায় দায়িত্বে আছেন। নাগরিক হিসেবে সরকারের সাফল্য রাষ্ট্রের উন্নয়ন তুলে ধরতে আগ্রহী। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে বলা রয়েছে, প্রত্যেক নাগরিকের আইনের আশ্রয় ও সাহায্য সহায়তা লাভের সুযোগ সুবিধা অবারিত করা হবে। ইশতেহারে এ অঙ্গীকারও আছে, দরিদ্র জনসংখ্যার হার হবে শতাংশে ১২.৩০; অতি দরিদ্র ৪.৫০। বিদ্যুৎ সরবরাহের ক্ষমতা হবে ২৮ হাজার মেগাওয়াট। করোনা ইউক্রেন যুদ্ধ মুল্যস্ফীতি নানাবিধ প্রতিকূলতার মধ্যে দারিদ্র্য হার এখন ১৮.৭ অতি দারিদ্র্য হার ৫.২। বিদ্যুৎ উৎপাদন বর্তমানে ২৬ হাজার ৭ শত মেগাওয়াটে উন্নীত হয়েছে। এসব তো সরকারের সাফল্যের সূচক। সাফল্য ধরে রেখে অব্যাহত গতিতে উন্নয়নের সুফল সকল নাগরিক উপভোগ করবেন- রাষ্ট্রের প্রতি নাগরিকের এতো চাওয়া পাওয়া। ইতোমধ্যে বর্তমান সরকার ৬ হাজার ৬৪৪ সার্কিট কি.মি. সঞ্চালন লাইন স্থাপন করেছে। ফলে সঞ্চালন লাইনের পরিমাণ বর্তমানে ১৪ হাজার ৬৪৪ কি.মি. এ উন্নীত হয়েছে। বিতরণ লাইনের পরিমাণ ৩ লক্ষ ৬৯ হাজার কি.মি. হতে ৬ লক্ষ ৬৯ হাজার কি.মি. এ বৃদ্ধি করা হয়েছে।

ফিরে আসি লাইনম্যান ক্রুদের দাবীসমূহ নিয়ে। সেখানে বলা হয়েছে- সকল লাইন ক্রু লেভেল-১ (চুক্তিভিত্তিক) কে নিয়মিত করতে হবে। আন্দোলনকে কেন্দ্র করে কোন লাইন ক্রুকে চাকুরি চ্যুত করা যাবে না এবং কারো বিরুদ্ধে কোন ধরনের প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে না। যে সকল লাইন ক্রু গণ লাইনে কাজ করতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন, তাদের পরিবারের একজন সদস্য (স্ত্রী, পুত্র, কন্যা, ভাই, বোন) যোগ্যতা অনুযায়ী পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিতে নিয়মিত কর্মচারী পদে নিয়োগ প্রদান করতে হবে। সকল লাইন ক্রুগণকে নিয়োগের তারিখ অনুযায়ী লাইন ম্যান গ্রেড-০১, গ্রেড-০২ শিক্ষানবিশ পদে পদমর্যাদা দিতে হবে। সকল লাইন ক্রুকে চাকুরির প্রবেশ কাল হতে এরিয়া বোনাস, ঈদ বোনাস, বৈশাখী ভাতা, চিকিৎসাভাতা ৫% বেসিক বৃদ্ধিসহ অন্যান্য সকল সুযোগ সুবিধা প্রদান করতে হবে। ২৪/৭ জরুরী সেবার স্বার্থে বর্তমান ইনস্ট্রাকশনের পরিবর্তন করে অফিসের ধরন অনুযায়ী লাইন ম্যান প্রাপ্তির সংখ্যা বৃদ্ধি করার মাধ্যমে সকল অফিসের লোকবল বৃদ্ধির পদক্ষেপ নিতে হবে। শুন্য পদে নিয়মিত লোকবল নিয়োগের মাধ্যমে লোকবলের ঘাটতি পূরণ করতে হবে। দুর্ঘটনার সংখ্যা হ্রাস করার জন্য যুগোপযোগী প্রশিক্ষণ প্রদান ও নিরাপত্তা সরঞ্জাম নিশ্চিত করতে হবে। ব্যানারে আন্দোলনের ৭ দফা উল্লেখ করা থাকলেও মূলত: প্রথম দফা চাকুরি নিয়মিত স্থায়ীকরণই তাদের প্রধান দাবী। অন্যান্য দফাগুলোর মধ্যে আন্দোলনকারী কর্মীবৃন্দ যে ভয় ভীতির মধ্যে রয়েছেন- সেটি স্পষ্ট। ক্রুম্যানবৃন্দ কাজ করেন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। তারা এখানে এসেছেন- এটাও তাদের উপলব্ধিতে রয়েছে যে বিদ্যুৎ লাইনের কর্মে ব্যাঘাত ঘটছে। কোন কোন জেলায় শুধু ইনচার্জ রয়েছেন। অন্য সকল ক্রুম্যান এখন ঢাকায়। কেউ কেউ দুর্ঘটনার ছবিও বহন করছেন। এসব তো প্রচলিত আইন, চাকুরির নীতি, বিধি মালা দিয়েই নিস্পন্ন করা সম্ভব। আইএলও কনভেশন রয়েছে যেখানে বাংলাদেশ অনুস্বাক্ষরকারী রাষ্ট্র। কর্মক্ষেত্রে মৃত্যু, দুর্ঘটনাজণিত ক্ষতির প্রতিকার কর্মীবৃন্দের অধিকার। এসব অধিকারই শ্রমিকের মানবাধিকার। রাষ্ট্র সকলের মানবাধিকার নিশ্চিত করবে। পল্লী বিদ্যুত এর ক্রুম্যান এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নয়। যদিও কিছু কর্মীর সাথে ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় জানা যায়- কর্তৃপক্ষ আন্দোলনকারী ক্রুম্যানদের সাথে বসে মীমাংসায় উপনীত হবেন। দাবীসমূহ দেখেই বুঝা যায়- বোনাসভাতা তাদের জুটে না। মৃত্যুর বিপরীতে পরিবারের সদস্যদের চাকুরিতে নিয়োগের ব্যবস্থা নেই। আধুনিক প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা চাচ্ছেন। লোকবল বৃদ্ধির কথাও রয়েছে। সবই তো স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার অংশ। প্রতিষ্ঠান ব্যবস্থাপনার সাথে যারা সম্পৃক্ত তাদের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় এ দাবীসমূহ পূরণ হওয়ার কথা। নিয়মতান্ত্রিক গ্রেড পদ মর্যাদা চাচ্ছেন। চাকুরি কাল থেকে এরিয়া বোনাস, ঈদ বোনাস বৈশাখী ভাতা- এসব তো যৌক্তিক দাবী। শুন্য কোঠা পূরণের দাবী রয়েছে। শৃঙ্খলার সাথে কর্মীবৃন্দ দাবী তুলে ধরেছেন। সরকার এক্ষেত্রে সহানুভূতিশীল হবেন- সচেতন নাগরিক এটি বিশ^াস করেন।

শ্রমিকের হাত ধরেই তো উন্নয়ন। আজকের বিকশিত বাংলাদেশের নেপথ্যের ইতিহাস শ্রমিকের অক্লান্ত শ্রমের অবদান। মহান মুক্তিযুদ্ধে যেমন মেহনতি মানুষ শ্রমজীবী কৃষক কামার কুমার সকলে অংশগ্রহণ করে বাংলাদেশ উপহার দিয়েছিলেন। ৭ দফা বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে বিদ্যুৎ সঞ্চালন নিরচ্ছিন্নতা অটুট থাকবে। বিদ্যুতের সাথে উৎপাদনশীলতা এবং উন্নয়নের সম্পর্ক নিবিড়। আমাদের উদ্দেশ্য ক্ষুধামুক্ত দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ। এ লক্ষ্য অর্জনে দেশের সরকারি বেসরকারি সকল পর্য্যায়ে সক্রিয় এবং ত্বড়িৎ ব্যবস্থা নিশ্চিত হোক। পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি’র ৫ হাজার কর্মীর দাবী পূরণের মধ্য দিয়ে তাদের মূখের হাসিটুকু দেখতে চাই। শ্রমিকের অধিকার মানবাধিকার সংরক্ষণ ও উন্নয়নে সংশ্লিষ্ট সকলের দায়িত্বশীলতাই- আমাদের প্রত্যাশা।
কলাম লেখক ও উন্নয়ন কর্মী

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

সংবাদটি শেয়ার করুন

নিউজলেটার সাবসক্রাইব

জনপ্রিয়

আপনার জন্য আরো কিছু সংবাদ
সম্পর্কিত