উড্ডয়নের পরপরই জ্বালানি ‘শেষ হয়ে গিয়েছিল’ এয়ার ইন্ডিয়ার

ভারতের আহমেদাবাদে দুর্ঘটনার শিকার হওয়া এয়ার ইন্ডিয়ার ফ্লাইটটি উড্ডয়নের কয়েক সেকেন্ড পরই জ্বালানি শেষ হয়ে গিয়েছিল বলে জানা গেছে। ভারতের এয়ারক্রাফট অ্যাক্সিডেন্ট ইনভেস্টিগেশন ব্যুরোর (এএআইবি) প্রাথমিক তদন্তে উঠে এসেছে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য।গত ১২ জুন লন্ডনগামী এয়ার ইন্ডিয়ার এআই১৭১ ফ্লাইটটি (বোয়িং ৭৮৭-৮ ড্রিমলাইনার) আকাশে ওড়ার অল্প সময়ের মধ্যেই একটি আবাসিক এলাকায় বিধ্বস্ত হয়। এতে বিমানে থাকা ২৪২ জনের মধ্যে ২৪১ জনই নিহত হন। তাছাড়া, যে এলাকায় বিমানটি বিধ্বস্ত হয়, সেখানবকারও ১৯ জন নিহত হন। এটি ছিল গত এক দশকের সবচেয়ে ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনা।আন্তর্জাতিক বিমান চলাচল বিধি মতে, দুর্ঘটনার ৩০ দিনের মধ্যে তদন্তকারী রাষ্ট্রকে প্রাথমিক প্রতিবেদন দিতে হয়।
ভারতের তদন্ত প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান জানিয়েছে, দুর্ঘটনায় বোয়িং কিংবা ইঞ্জিন নির্মাতা জিই’র কোনো ত্রুটি পাওয়া যায়নি। বরং ককপিটের যে সুইচগুলো দিয়ে ইঞ্জিনে জ্বালানি সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করা হয়, সেগুলো ‘কাট-অফ’, অর্থাৎ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বিমানটি স্থানীয় সময় দুপুর ১ টা ৩৮ মিনিট ৪২ সেকেন্ডে ১৮০ নট ইন্ডিকেটেড এয়ারস্পিড (আইএস) গতি অর্জন করে। ঠিক তার পরপরই ইঞ্জিন ১ এবং ইঞ্জিন ২–এর জ্বালানি সরবরাহ সুইচগুলো ‘রান’ থেকে ‘কাট-অফ’ অবস্থায় চলে যায়। এটি মাত্র এক সেকেন্ডের ব্যবধানে এই অবস্থায় চলে যায়। এর ফলে জ্বালানি সরবরাহ বন্ধ হয়ে ইঞ্জিন দুটির এন১ ও এন২ মান কমতে শুরু করে।প্রতিবেদন আরও জানানো হয়েছে, রানওয়ের সীমানা প্রাচীর অতিক্রম করার আগেই বিমানটির উচ্চতা কমতে শুরু করে।
ককপিট ভয়েস রেকর্ডার থেকে জানা গেছে, এক পাইলট অপর পাইলটকে ওই সময় জিজ্ঞেস করেন, ‘তুমি কেন জ্বালানি বন্ধ করলে?’জবাবে অপর পাইলট বলেন যে, তিনি জ্বালানি বন্ধ করেননি।তবে কোন পাইলট এই কথা বলেছিলেন কিংবা কে ‘মে ডে, মে ডে, মে ডে’ সংকেত পাঠিয়েছিলেন, সে বিষয়ে প্রতিবেদনে কিছু উল্লেখ নেই।দুর্ঘটনায় নিহত বিমানটির কমান্ডার ছিলেন ৫৬ বছর বয়সী সুমিত সাবরওয়াল, যার ১৫ হাজার ৬৩৮ ঘণ্টার বেশি ফ্লাইট পরিচালনার অভিজ্ঞতা ছিল। এ ছাড়া এয়ার ইন্ডিয়ার প্রশিক্ষক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করতেন তিনি। সহকারী পাইলট ক্লাইভ কুন্ডারের বয়স ছিল ৩২ বছর, তার মোট ফ্লাইট অভিজ্ঞতা ছিল ৩ হাজার ৪০৩ ঘণ্টা।তবে সুইচগুলো কীভাবে কাট-অফ অবস্থায় গেল, প্রতিবেদনে সে বিষয়ে স্পষ্ট করে কিছু উল্লেখ করা হয়নি।যুক্তরাষ্ট্রের বিমান নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ জন কক্স বলেন, ‘পাইলটের পক্ষে ভুল করে এই সুইচ টেনে ফেলা সম্ভব নয়।
তিনি বলেন, ‘এই সুইচগুলো এমন নয় যে হঠাৎ ধাক্কা লাগলে নিজেরা সরবে।’ সুইচগুলোর কাট-অফ মোডে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যায় বলে জানান এই বিশেষজ্ঞ।সাধারণত রানওয়েতে পৌঁছানোর পর ফ্লাইটের ইঞ্জিন বন্ধ করতে কিংবা বিশেষ জরুরি পরিস্থিতিতে, যেমন: ইঞ্জিনে আগুন লাগলে এই সুইচ ব্যবহার করা হয়। কিন্তু ওই ফ্লাইটে এমন কোনো জরুরি পরিস্থিতির কথা প্রতিবেদনে বলা হয়নি।যুক্তরাষ্ট্রের আরেক বিমান নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ অ্যান্থনি ব্রিকহাউস বলেন, ‘যদি পাইলট সুইচ ঘুরিয়ে থাকেন, তাহলে তিনি তা কেন করলেন?’ প্রতিবেদন অনুযায়ী, দুটি সুইচ এক সেকেন্ডের ব্যবধানে কাট-অফ অবস্থায় চলে যায়।বিশেষজ্ঞ জন ন্যান্সের মতে, সময়ের এই ব্যবধান দেখেই বোঝা যায়, একজন ব্যক্তি প্রথমে একটি এবং পরেই আরেকটি সুইচ ঘোরালে এমনটি হতে পারে। তিনি বলেন, ‘উড্ডয়নের ঠিক পরপরই পাইলট কখনোই স্বেচ্ছায় এই সুইচ বন্ধ করবেন না।’প্রতিবেদনের একটি অংশে বলা হয়, ইঞ্জিন ১ কাট-অফ হওয়া সত্ত্বেও কিছুটা পুনরুদ্ধার শুরু করেছিল, তবে ততক্ষণে বিমানের গতি কমে যাওয়া তা আর সম্ভব হয়ে ওঠেনি।প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইঞ্জিন ১–এর ‘কোর ডেসিলারেশন’ বন্ধ হয়ে উল্টো ঘুরে গিয়ে কিছুটা পুনরুদ্ধার শুরু করে, তবে ইঞ্জিন ২ ‘রিলাইট’ (পুনরায় চালু) হলেও গতি কমা ঠেকাতে পারেনি।এয়ার ইন্ডিয়া এক বিবৃতিতে জানায়, তারা ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সহযোগিতা করছে।
তবে এ বিষয়ে বিস্তারিত কোনো মন্তব্য করেনি।যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ট্রান্সপোর্টেশন সেফটি বোর্ড এক বিবৃতিতে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সহযোগিতার জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে বলেছে, এই প্রতিবেদনটিতে বোয়িং ৭৮৭ জেট বা জিই ইঞ্জিন পরিচালকদের জন্য কোনো সতর্কতামূলক সুপারিশ নেই।যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল এভিয়েশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বলছে, তারা তদন্তে বেরিয়ে আসা সত্যের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে এবং কোনো ঝুঁকি চিহ্নিত হলে দ্রুত ব্যবস্থা নেবে।তাছাড়া বোয়িং জানিয়েছে, তদন্তকাজে তারা এয়ার ইন্ডিয়াকে সহায়তা করছে। তবে জিই অ্যারোস্পেসের পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিকভাবে কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছে দ্য গার্ডিয়ান।বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ফলে অন্তত পাঁচটি ভবন ধ্বংস হয়েছে এবং নিচে থাকা ১৯ জন মারা গেছেন। বিধ্বস্ত হওয়া ভবনগুলোর মধ্যে একটি ছিল বাইরামজি জিজিভয় মেডিকেল কলেজ ও সিভিল হাসপাতালের ছাত্রাবাস।দর্ঘটনার কয়েকদিন পর দুটি ব্ল্যাক বক্স উদ্ধার হয়।
১৩ জুন একটি ব্ল্যাক বক্স দুর্ঘটনাস্থলের একটি ভবনের ছাদ থেকে এবং ১৬ জুন অপরটি ধ্বংসস্তূপের ভেতরে পাওয়া যায়।তবে পাখির সঙ্গে ধাক্কা লেগে দুর্ঘটনার আশঙ্কা প্রতিবেদনে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। ওই ফ্লাইটপথে পাখির তেমন উপস্থিতির প্রমাণ মেলেনি বলেও জানানো হয়েছে।বিমানটিতে ১৬৯ জন ভারতীয় নাগরিক, ৫৩ জন ব্রিটিশ, সাতজন পর্তুগিজ, একজন কানাডীয় এবং ১২ জন ক্রু সদস্য ছিলেন।এই ভয়াবহ দুর্ঘটনায় একমাত্র যাত্রী হিসেবে বেঁচে যান ব্রিটিশ নাগরিক বিশ্বাস কুমার রমেশ। তিনি বিমানের ধ্বংসস্তূপের একটি ফাঁকা জায়গা দিয়ে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হন।হাসপাতালের শয্যা থেকে গত মাসে রমেশ বলেছিলেন, ‘উড্ডয়নের ঠিক পরপরই মনে হয়েছিল বিমানটি যেন আকাশে আটকে গেছে। এরপর বিমানের লাইটগুলো জ্বলা–নেভা শুরু করে।’তিনি বলেন, ‘হঠাৎ করেই বিমানটি একটা ভবনে ধাক্কা মেরে বিস্ফোরিত হয়।’আমি ভাবতেই পারিনি বেঁচে যাব। এক মুহূর্তের জন্য মনে হয়েছিল, আমিও মারা যাব। কিন্তু যখন চোখ খুলে চারপাশে তাকালাম, তখন বুঝলাম বেঁচে আছি। এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না—কীভাবে বেঁচে ফিরলাম।’
তি