আজ বরিশাল মুক্ত দিবস

প্রকাশঃ Dec 8, 2025 - 13:19
আজ বরিশাল মুক্ত দিবস

আজ ৮ ডিসেম্বর বরিশাল মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বরিশাল থেকে পালিয়ে যাওয়ায় মুক্ত হয় শহর। নগরীর নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেন মুক্তিসেনারা। বিজয়ের এই দিনে বরিশালের সর্বত্র উড়ানো হয় স্বাধীন বাংলার পতাকা। 

বরিশালের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৯৭১ সালে ২৫ মার্চ মধ্য রাতে ঢাকায় অপারেশন সার্চলাইট শুরু করার পর বরিশালে মুক্তিযোদ্ধারা তৎকালীন পুলিশ সুপার ফখরুল ইসলামের কাছ থেকে অস্ত্রাগারের চাবি নিয়ে নেন। তারা পুলিশের অস্ত্রাগার থেকে শত শত রাইফেল, গোলবারুদ নিয়ে নুরুল ইসলাম মঞ্জুরের পেশকারের বাড়ি নিয়ে যান। ২৬ মার্চ ভোরে ৯ নম্বর সেক্টর কমান্ডার এমএ জলিলকে সাথে নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা বরিশালের সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ে দক্ষিণাঞ্চলের প্রথম স্বাধীন বাংলা সচিবালয় গঠন করেন। ২৬ মার্চ থেকে ২৫ এপ্রিল দীর্ঘ এক মাস মুক্তিযোদ্ধারা এই স্থান থেকেই অনেক অভিযান পরিচালনা করেন।

২৫ এপ্রিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী সড়ক-আকাশ ও নৌপথ থেকে একযোগে বরিশাল আক্রমণ শুরু করে। বরিশালে ঢোকার মুখে চরবাড়িয়া ও গৌরনদীর কটকস্থলে তারা মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হয়। চরবাড়িয়ায় গণহত্যা চালিয়ে অর্ধশতাধিক সাধারণ মানুষ মেরে ফেলার পর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কীর্তনখোলা নদী সংলগ্ন বরিশালের পানি উন্নয়ন বোর্ড অফিসে দক্ষিণাঞ্চলীয় হেড কোয়ার্টার গড়ে তোলেন। সেখানে বাংকার খুঁড়ে, ভারি অস্ত্রের সমাবেশ ঘটান তারা। প্রতিদিন বরিশাল, ঝালকাঠি, গৌরনদীসহ দূর-দূরান্ত থেকে নিরীহ মানুষদের ধরে এনে তারা গুলি করে হত্যা করে লাশ খালে ফেলে দিত। এই ওয়াপদা সংলগ্ন খাল ও ব্রিজে মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে প্রায় তিন হাজার মানুষকে মেরে ফেলা হয়। 

ডিসেম্বরে মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ তীব্র হলে পাক-হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা চিন্তিত হয়ে পড়ে। ৭ ডিসেম্বর রাত থেকে শহরে জারি করা হয় অনির্দিষ্টকালের সান্ধ্য আইন। ৮ ডিসেম্বর সকালে জেলা প্রশাসকের দপ্তরে এক বৈঠকে মিলিত হয় তারা। শহরে কারফিউ চলাকালে সকাল ১০টায় বৈঠক শেষ করে পাকিস্তানি বাহিনী বরিশাল ছেড়ে নৌপথে পালানোর উদ্যোগ নেয়। খবর পেয়ে ভারতীয় বিমানবাহিনী পলায়নরত পাকিস্তানি বাহিনীর গানবোট, স্টিমার ও লঞ্চ লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করে। এতে পাকিস্তানি বাহিনীর স্থানীয় প্রধানসহ যোগী শাজাহান চৌধুরীসহ তাদের বহু দোসর নিহত হয়।

বরিশালে একাত্তরে বাঙালি হত্যা ও নির্যাতনের কেন্দ্র পাক-বাহিনীর টর্চার সেলটিকে ভিন্ন এক রূপ দেয়া হয়েছে। নির্যাতনের দুঃসহ স্মৃতি বিজড়িত স্থানটিকে গড়ে তোলা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের স্মারক হিসেবে। নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্ভুদ্ধ করতেই ইতিহাসের স্বাক্ষী ধ্বংসস্তুপ ভবনগুলোকে সংরক্ষণ করা হয়েছে বরিশালের ওয়াপদা কলোনিতে (টর্চার সেল)। পাকিস্তানি হানাদারদের নির্যাতন কেন্দ্রে বন্দী ছিলেন বলে জানান অনেক মুক্তিযোদ্ধা।

জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা দলের কেন্দ্রীয় সহ সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুর আলম ফরিদ বলেন, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বরিশাল আসে ২৫ এপ্রিল ১৯৭১। ওই দিন গানবোট ও হেলিকপ্টারে করে পাকিস্তানি বাহিনীর একাধিক দল স্টিমারঘাট, বিসিক ও চরবাড়িয়া এলাকা দিয়ে শহরে প্রবেশ করে। বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বিপরীতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কলোনি দখল করে তাদের ক্যাম্প বানায়। ক্যাম্পের পশ্চিমদিকে সাগরদী খালের তীরে বাংকার তৈরি করে সশস্ত্র পাহারা দিত পাকিস্তানি সেনারা।

বীর মুক্তিযোদ্ধা ইসরাইল পন্ডিত বলেন, বরিশাল তথা গোটা দক্ষিণাঞ্চলে ওয়াপদা কলোনির মতো এত বড় নির্যাতন ক্যাম্প ও বধ্যভূমি আর কোথাও ছিল না। বরিশালের ওয়াপদা কলোনিতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী গুছানো ছিলো। আর ঝালকাঠি, পটুয়াখালী ও ভোলাসহ অন্যান্য জেলায় বিক্ষিপ্ত ভাবে হামলা চালাত পাকিস্তানি বর্বর বাহিনী। ওয়াপদা কলোনিতে নিয়ে কত মানুষকে হত্যা ও নির্যাতন চালানো হয়েছে, তার সুনির্দিষ্ট হিসাব নেই।

বরিশালের ওয়াপদা কলোনির টর্চার সেলে ঘুরতে আশা আগত দর্শনার্থী শরীফ উদ্দিন বলেন, প্রতিদিন বিকেল ৪টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত উন্মুক্ত থাকে সবার জন্য। আবহসঙ্গীত আর নিয়ন আলোয় এ এক অন্য ভূবন। অনেকেই নিছক ঘুরতেই আসেন এখানে। কিন্তু আসার পর পাল্টে যায় তার ভাবনা। ইতিহাসের এই কাঠগড়ায়ে দাঁড়িয়ে নিজেকেই নিজে বলে ওঠে, সত্যি ই তো, রক্তেই কেনা এ আমার স্বদেশ। কারো দানে পাওয়া নয়। আগতরা বলেন, এ ইতিহাস সংরক্ষনের মধ্য দিয়ে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম শপথ করবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পথেই হাটবে বাংলাদেশ।