শশশ…

সাখাওয়াত হোসেন
— বলুন কি সমস্যা?
মোবাইলে টাইম দেখে বরাবরের মতো অবাক হলাম আমি। চারটা বেজে চুয়াল্লিশ মিনিট। অবাক হওয়ার মতো কোনো বিষয় না হলেও অবাক হচ্ছি কারণ এটা প্রথমবার নয়। প্রায় এক সপ্তাহ ধরে ব্যাপারটা ঘটছে। হঠাৎ করে মোবাইল হাতে নিয়ে টাইম দেখছি, দেখা গেলো টাইম দেখানোর তিনটা কিংবা চারটা সংখ্যাই এক।
প্রথমবার পাত্তা দিইনি, কাকতালীয় ব্যাপার ভেবেছি। কিন্তু একনাগাড়ে বারবার একই ব্যাপার দেখে অবাক হচ্ছি এখন। অবশ্য নিতু হেসে উড়িয়ে দিচ্ছে ব্যাপারটা। গতরাতে ঘুম ভাঙ্গলো হুট করে, পানি খেয়ে এসে মোবাইল হাতে নিয়ে দেখি ১১ টা বেজে ১১ মিনিট! নিতু কে জাগিয়ে বললাম,
— দেখো। তুমি তো পাত্তা দিচ্ছোনা! যখনই সময় দেখছি, তখনই এই অবস্থা!
নিতু ঘুম জড়ানো গলায় বললো,
— তো কি হয়েছে? ঐ সংখ্যাগুলো তোমায় কামড় দিচ্ছে?
— তুমি বুঝতে পারছো না কেন, সামথিং ইজ রং। কাকতালীয় ব্যাপার হলে একবার দু’বার হবে, বারবার হবেনা!
নিতু মুখে এসে পড়া চুল- ঘাড় সামান্য তুলে দু’হাতে পেছনে সরিয়ে দিতে দিতে বলে,
— ওকে, বলছি আসলে কি হচ্ছে। ব্যাপারটা সময় নয়, তুমি সৃষ্টি করেছো! তুমি একটা নির্দিষ্ট সময়ে টাইম দেখছো। আমরা যখন ঘড়িতে একটা নির্দিষ্ট সময়ে এলার্ম দিয়ে রোজ উঠি, অভ্যেস হয়ে যাওয়ার পর একদিন এলার্ম না বাজলেও ঐ সময়টায় ঘুম ভেঙ্গে যায়। তোমার সাথেও একই ব্যাপার ঘটছে। তুমি ঠিক সেইম টাইমেই তোমার নিজের অজান্তেই মোবাইল হাতে নিচ্ছো, সময় দেখছো…
নিতুর ব্যাখ্যা আমার মনঃপুত হয়না কখনো, এখনো হলোনা। বলি,
— অভ্যেস দু’দিনে সৃষ্টি হয়না নিতু! এর আগে কখনো হয়নি, পাঁচ ছয়দিন হলো এমন হচ্ছে। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে, এই সময়টা আশ্চর্য একটা সময়। আশ্চর্য কিছু একটা ঘটবে আমার সাথে।
নিতু আমার দিকে তাকায়, যেন এলিয়েন দেখছে। তাকিয়ে বলে,
— তুমি একটা ডাক্তার। অর্ধেক জীবন বিজ্ঞান পড়ে কাটিয়েছো। আমার কিছুই বলার নাই তোমায় আর। ঘুমাও।
….
চেম্বারে আছি চারটা থেকে ছয়টা পর্যন্ত। সিরিয়ালে আছে বিশ- ত্রিশেক লোক। এখন একজন বসে আছেন টেবিলের ওপাশের চেয়ারে।
একজন মহিলা। কালো বোরকা- হিজাব পরা। চোখ দু’টো দেখা যাচ্ছে শুধু। কাজল দেয়া। চোখ ছলছল করছে। মহিলা কাঁদছেন কিনা বুঝা যাচ্ছেনা। মহিলার কোলে একটা বাচ্চা। সাদা চাদর দিয়ে বাচ্চার সমস্ত শরীর জড়ানো, বাচ্চা চাদরের ভেতর থেকে হাত পা নড়াচড়া করছে। মহিলা চুপ করে আছেন। আমি আরেকবার জিজ্ঞেস করলাম,
— বলুন কি সমস্যা?
মহিলা হাত সামান্য উঁচু করে কোলের বাচ্চাটিকে দেখালেন আমায়। বাচ্চার বয়স সম্ভবত সাত- আট মাস। আমি প্রথমে ভেবেছি, সমস্যাটা মহিলার। ভুল ভাঙ্গলো। বাচ্চাকে দেখাতে নিয়ে এসেছেন তিনি। আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম,
— হ্যাঁ বলুন, বাচ্চার কি সমস্যা?
মহিলা ডানপাশের দরজার দিকে তাকালেন, তারপর আমার দিকে। একবার বাচ্চার দিকে এবং তারপর টেবিলের দিকে তাকালেন। মনে হলো, মহিলা ঠিক গুছিয়ে উঠতে পারছেন না কোথা থেকে শুরু করবেন। ডাক্তারদের ধৈর্যশক্তি প্রচন্ড, আমি ধৈর্য ধরে রইলাম। তারপর মহিলা চট করে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে স্পষ্ট স্বরে বললেন,
— আমার বাচ্চাটা মাঝে মাঝে পরিষ্কার বাংলায় কথা বলে…
থতমত খেয়ে জিজ্ঞেস করলাম আমি,
— মানে?
মহিলা কোলের বাচ্চাটিকে আবারো সামান্য উঁচু করে আমায় দেখালেন। তারপর হতাশ তবে স্পষ্ট স্বরে বললেন,
— আমার বাচ্চা…। ওর বয়স সাত মাস। ও আর দশটা স্বাভাবিক বাচ্চার মতো নয়। জন্মাবার পর চিৎকার করে কাঁদেনি, এখনো কাঁদেনা। কান্না পেলে ঠোঁট কাঁপে, আর চোখ দিয়ে সমানে পানি বের হয়। হাসে; হাসিতে শব্দ হয়না।
আমি চুপ করে হা হয়ে মহিলার কথা শুনছি, কে জানতো, আমার ডাক্তারি জীবনের সবচেয়ে অদ্ভুত সময়টার মুখোমুখি হতে যাচ্ছি আমি!
….
— আমার নাম রাবেয়া। আমার বাচ্চাটার এখনো নাম রাখিনি, একেকজনে একেক নামে ডাকে। ওর বাবা ডাকে, পুঁটি। দাদা- দাদী ডাকে, মনি। চাচা ডাকে জয়ী। চাচা অবশ্য ঘোষণা করে দিয়েছে, ওর নাম জয়ীই রাখা হবে। আমি ডাকি, চুপকথা। আমরা বাবা- মা, স্বামী আর স্বামীর ছোটভাই সবাই একসাথে। আমার বাচ্চার প্রথম কথা বলার ঘটনাটা বলি। সেদিন শুক্রবার। দুপুরবেলা। সবাই জুমআ পড়তে গেলো। বাসায় আমি ছাড়া আর দু’জন। মা এবং স্বামীর ছোট ভাই। সে জুমআ পড়েনা। নাম জুনায়েদ। বয়স পঁচিশ- ছাব্বিশ হবে। চাকুরি খুঁজছে, আপাতত বেকার। দুপুরে আমি বাচ্চাকে ঘুম পাড়িয়ে স্নান করতে ঢুকি, বের হয়ে দেখি রুমে জুনায়েদ। বিছানায় বসে আছে। আমি লজ্জার চেয়েও বেশি ভয় পাই। গা কাঁপতে থাকে আমার। তারপরেও গায়ের কাপড় টেনে আরেকটু জড়িয়ে নিয়ে জোর করে স্বাভাবিক থেকে কাঁপা কাঁপা স্বরে বলি, ‘কি ব্যাপার জুনায়েদ? জুমআ পড়োনা কেন তুমি?’ জুনায়েদ আমার দিকে ঘোর লাগা চোখে তাকায়। আমি বুঝতে পারি ওর চোখের ভাষা। ভয়ে গা শিউরে উঠে। আমার চিৎকার করতে ইচ্ছে করে। অথচ চিৎকার করে লাভ নেই। মা কানে তেমন শুনেন না, শুনলেও উঠে যে এই রুমে আসবেন সেই ক্ষমতাও উনার নেই। আমি কি করবো ভেবে পাইনা। জুনায়েদ আমার দিকে এগিয়ে আসে, আমি হাতজোড় করে বলি। ‘প্লিজ জুনায়েদ, তুমি আমার ছোট ভাইয়ের মতো। পাপ হবে, প্লিজ।’ জুনায়েদ মুচকি হাসে, আমার গা শিউরে উঠে। জুনায়েদ এসে আমার ভয়ে কাঁপতে থাকা শরীর স্পর্শ করে। ঠিক তখনিই প্রথমবার চিৎকার করে কেঁদে উঠে আমার বাচ্চাটা! আমার মতো জুনায়েদও ভীষণ চমকে উঠে, প্রথমবারের মতো বাচ্চার কান্নার আওয়াজ শুনে। আমি ঝটকা দিয়ে ওর হাত সরিয়ে বাচ্চাকে কোলে নিয়ে পাশের বাসায় চলে যাই। তবে কাউকে কিছু বলিনা, বাসায় আসলে কি ঘটছে।
রাবেয়া থামলো, আমি পানি এগিয়ে দিলাম। পানি খাওয়ার জন্যে রাবেয়া হিজাব খুললো। আমার চোখ ধাঁধিয়ে গেলো একমুহূর্তের জন্যে। স্নিগ্ধ একটা মুখ, চিকন নাক, নাকের উপর একটা তিল রাবেয়ার। পানি খেয়ে আবার হিজাব পরে রাবেয়া বলতে শুরু করলো,
— আমি বাচ্চার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে আল্লাহকে ধন্যবাদ দিই। বাচ্চার এতোটুকুন চেহারায় আমি স্পষ্ট দেখি লালচে আভা। প্রচন্ড রাগে কান্না করলে ফর্সা মানুষের চেহারা যেমন লালচে হয়ে যায়, ঠিক তেমন। কেন যেন বাচ্চা রেগে আছে! কি অদ্ভুত! আমি বাচ্চার কপালে, তুলতুলে নাকে, গালে চুমুতে ভরিয়ে দিই। বাচ্চার লালচে চেহারা আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হয়ে আসে। সে রাতে স্বামীকে অনেকবার বলতে যেয়েও থমকে থমকে গেলাম। তারপর বললাম