মুখোশ পরা মানুষ

ইমদাদুল হক মিলন
রিসেপশন থেকে ফোন এলো। ‘স্যার, এক ভদ্রমহিলা আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন।’চায়ে চুমুক দিতে দিতে আসিফ সেদিনকার খবরের কাগজ দেখছিল। এখন খবরের কাগজ আর পড়া হয় না। শুধু চোখ বোলানো। হেডলাইনগুলি দেখা। ওসব হেডলাইন দেখতে দেখতে বলল, ‘কী নাম?’‘নাম বলেননি।’
আসিফ তেমন অবাক হলো না। সে যেখানেই যায় এরকম অনেক মহিলাই তার সঙ্গে দেখা করতে আসেন। নানা রকম সমস্যার কথা বলেন। সমাধানের পরামর্শ চান। মফস্সলে এলে ব্যাপারটা বেশি ঘটে। তা ঘটবার কথা। আসিফের এনজিও সমস্যা জর্জরিত নারীদের নিয়ে কাজ করে, সুবিধাবঞ্চিত নারীদের নিয়ে কাজ করে। কয়েকটি দেশ থেকে ফান্ড আসে। বনানীতে সুন্দর অফিস তাঁর। কর্মীদের বেশিরভাগই মেয়ে। আসিফের চেহারাও ইদানীং মানুষের কাছে পরিচিত। বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে নারীদের নানা রকম সমস্যা নিয়ে টক শো করে। এসব বিষয় নিয়ে দেশের জেলা-উপজেলা পর্যায়ে সেমিনার করে। নিজের সম্পর্কে নারীদের সচেতন করা, তাদের অধিকার আদায় করে নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া ইত্যাদি বিষয়ে সেমিনার।
আসিফের বয়স একান্ন। সে একাকী জীবন কাটায়। সংসার ছিল। ভেঙে গেছে। প্রেম করে বিয়ে করেছিল সাদিয়াকে। বিয়ের দু-বছর পর মেয়ে হলো। সাদিয়া কাজ করত আমেরিকান একটা কোম্পানিতে। আসিফ তখন এনজিও নিয়ে নেমেছে। অন্য নারীদের সমস্যা দেখতে শুরু করেছে। নিজের নারীটির দিকে ফিরেও তাকাচ্ছিল না। উলটো মেজাজ দেখাত। খারাপ ব্যবহার করত। সাদিয়া প্রথম প্রথম কিছু বলেনি। পরে এই নিয়ে শুরু হলো বিরোধ। শেষ পর্যন্ত ডিভোর্স। মেয়েকে নিয়ে সাদিয়া চলে গেল আমেরিকায়। প্রথম প্রথম মেয়ের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল আসিফের। এখন সেই যোগাযোগও ক্ষীণ।‘কী বলব, স্যার?’‘ও, বলুন আজ দেখা হবে না। আমার একটা সেমিনার আছে। খুবই ব্যস্ত থাকব। কাল আসতে বলুন।’
‘জি স্যার।’খানিক পর আবার ফোন এলো। ‘সরি, স্যার। উনি টেলিফোনে একটু কথা বলতে চান।’আসিফ বিরক্ত হলো। ‘ঠিক আছে। দিন।’ভদ্রমহিলা ফোন ধরেই বললেন, ‘আমি কোনো সাহায্য-সহযোগিতা বা পরামর্শ চাইতে আসিনি। আপনাকে অন্য কিছু কথা বলব। আপনার অতীত জীবন নিয়ে।’কণ্ঠস্বর পরিচিত মনে হলো। কোথায় যেন শুনেছে আসিফ। একটু হাস্কি ভয়েস। বেশ আকর্ষণ আছে কণ্ঠে।আসিফ থতমত খেয়েছিল। নিজেকে সামলে বলল, ‘আমার অতীত নিয়ে কথা বলবেন? কে আপনি? কী নাম?’‘আমার নাম শ্রাবণী। ঠিক আছে, আপনি যখন ব্যস্ত, আমি কাল আসবো। কখন এলে ভালো হয় বলুন তো!’এ সময় এলেই হবে। কাল আমার তেমন কোনো কাজ নেই। লাঞ্চের পর ঢাকায় রওনা দেব।’
‘ঠিক আছে।’কাজের ফাঁকে ফাঁকে সারাটা দিনই শ্রাবণীর কথাগুলি কানে বেজেছে আসিফের। রাতের বেলা বিছানায় শুয়ে বেশ কিছুক্ষণ ভেবেছে। শ্রাবণী কে? তার অতীত জীবন নিয়ে কী বলতে চান? কণ্ঠস্বর পরিচিত মনে হলো! যেন এই কণ্ঠ আগে শুনেছে।কোথায় শুনেছে মনে করতে পারল না আসিফ।সকালবেলা ঠিক সময়েই শ্রাবণী এলেন। রিসেপশন থেকে ফোন আসতেই আসিফ ধরল।‘স্যার, শ্রাবণী ম্যাডাম এসেছেন।’‘ফোনটা তাঁকে দিন।’শ্রাবণী ফোন ধরলেন। ‘জি, বলুন।’‘আমার রুমে আসতে অসুবিধা নেই তো? চা খেতে খেতে আপনার কথা শুনলাম।’কোনো আপত্তি নেই।’খানিক পর রিসেপশনের একটি মেয়ে শ্রাবণীকে আসিফের রুমে পৌঁছে দিয়ে গেল।
কালো বোরখায় নিজেকে সম্পূর্ণ আবৃত করে রেখেছেন শ্রাবণী। শুধু তাঁর চোখদুটো দেখা যাচ্ছে। টানা টানা চোখ। এই চোখও আসিফের পরিচিত মনে হলো।বসুন, প্লিজ।’‘ধন্যবাদ।’
শ্রাবণী মুখোমুখি সোফায় বসলেন।
‘চা চলবে তো?’
‘না, আমি চা খেয়ে বেরিয়েছি। আপনি খান। আপনার তো ঘন ঘন চায়ের অভ্যাস।’‘জানলেন কী করে?’আমি আপনার সম্পর্কে অনেক কিছুই জানি। তবে সেসব বলতে আসিনি। একটা ঘটনা বলতে এসেছি।’
‘আপনার কণ্ঠ পরিচিত মনে হচ্ছে। চোখদুটোও যেন আগে দেখেছি।’‘এ রকম চোখ অনেক মহিলারই আছে। আমার মতো কণ্ঠও আছে কারো কারো।’আসিফ বুঝল শ্রাবণী তার কথা এড়িয়ে গেলেন। সে চায়ে চুমুক দিলো।‘একটা অনুরোধ করতে পারি?’জানি কী অনুরোধ। সেটা না করাই ভালো। আমার মুখ আপনাকে আমি দেখাব না।’‘আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে। তা হলে ঘটনাটা বলুন। কাল অবশ্য বলেছিলেন আমার অতীত জীবন নিয়ে কথা বলবেন।’ওসব না বললে আপনি হয়তো আমার সঙ্গে দেখাই করতেন না।’এই ধারণাটা ঠিক না। দেখা আমি করতাম। আপনার কথাও শুনতাম। ওসবই আমার কাজ।’‘এবার তাহলে আসল কথায় যাই?’প্লিজ।’
‘মেয়েটার নাম ছিল কলি। বাংলাদেশের গ্রামে এখনো গর্ভবতী নারীকে বাপের বাড়িতে রাখার নিয়ম। কলির মা গর্ভবতী হওয়ার পর তাকেও বাবার বাড়িতে রাখা হলো। মেয়ে জন্ম দিতে গিয়ে মা গেল অসুস্থ হয়ে। মেয়ের কিছুই হলো না, চার মাস পর মা মারা গেল। অসুস্থ স্ত্রীকে আর মেয়েকে কলির বাবা দেখতেও আসত না। দ্বিতীয় বিয়ে করে নতুন সংসার শুরু করল। কলিকে কোলে তুলে নিল তার মামি। মামা গরিব কৃষক। সামান্য জমি আছে। ওই চাষ করে তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে অতিকষ্টে চলেন। কলি হয়ে গেল মামা-মামির চতুর্থ সন্তান। নিজের ছেলেমেয়েদের তেমন লেখাপড়া করালেন না মামা কিন্তু কলিকে স্কুলে পাঠালেন। কারণ পড়াশোনায় ব্যাপক আগ্রহ মেয়েটির। অন্যদিকে কলি দেখতে সুন্দর। লম্বা, স্লিম। গায়ের রং ফর্সা, মাথাভর্তি চুল, টানা টানা চোখ। মুখটা মিষ্টি, মায়াবী। লেখাপড়ায় ভালো বলে স্কুলে বেতন দিতে হয় না। বইপত্রও কিনতে হয় না। টিচাররা কিনে দেন। এসএসসিতে ভালো রেজাল্ট করল সে। উপজেলার কলেজে ভর্তিও হয়ে গেল।’‘এ সময় মাস্তান লাগল কলির পেছনে।’শ্রাবণী অবাক হলেন না। ‘এটা অবশ্য অনুমান করে বলা যায়। এ রকমই হয়। কলির পেছনে লাগল এলাকার এক টাকাওয়ালা লোকের বখাটে ছেলে।’‘আমি কি সিগারেট ধরাতে পারি?’
‘আমার অবশ্য সিগ্রেটের গন্ধ একদমই পছন্দ হয় না। তবু আপনি খান।’আসিফ সিগারেট ধরাল। ‘তারপর? বলুন।’
‘অবস্থা এমন দাঁড়াল, কলি না কলেজে যেতে পারে, না বাড়িতে থাকতে পারে। গ্রামের চেয়ারম্যান, মেম্বার বা প্রভাবশালী লোকদের ধরেও কাজ হলো না। ছেলেটির নাম মিজান। কলিকে পাওয়ার জন্য সে পাগল হয়ে গেছে। শেষ পর্যন্ত বাড়িতে এসে হানা দিতে লাগল। ধরে নিয়ে যাবে কলিকে। জোর করে বিয়ে করবে। মামা-মামি খুবই বিপদে পড়েছেন মেয়েটিকে নিয়ে