বন্যায় বারবার ভেসে যায় স্বপ্ন, টেকসই বাঁধ চায় ফেনীবাসী

প্রকাশঃ Jul 12, 2025 - 12:30
বন্যায় বারবার ভেসে যায় স্বপ্ন, টেকসই বাঁধ চায় ফেনীবাসী

বর্ষা শুরু হতে না হতেই বন্যার আশঙ্কা উদয় হয় ফেনীবাসীর মনে। বন্যার ধ্বংসযজ্ঞ এই জেলায় যেন এক পরিচিত পুনরাবৃত্তি, বছর বছর ফিরে আসে একই দুর্যোগ, আর থেকে যায় দগদগে ক্ষত। প্রশ্ন ওঠে, টেকসই বাঁধ নির্মাণ কি হবে না? ফেনীবাসী কি রক্ষা পাবে না বন্যার ভয়াবহ থাবা থেকে?শনিবার (১২ জুলাই) দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম ফেনীর বন্যাকবলিত এলাকা পরিদর্শনে যান। সে সময় স্থানীয়রা টেকসই বাঁধ নির্মাণের জন্য তার কাছে দাবি জানান। জবাবে ফেনীতে বাঁধ নির্মাণের জন্য ৭ হাজার ৩৪০ কোটির প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।সম্প্রতি ভারতের উজান থেকে নেমে আসা বাঁধভাঙা পানি পরশুরাম ও ফুলগাজী থেকে গড়িয়ে ছাগলনাইয়া ও ফেনী সদর উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে ঢুকে পড়ে। শুক্রবার পর্যন্ত বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ২৩টি স্থানে ভেঙে ১১২টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। বন্যাকবলিত গ্রামগুলোর অন্তত ৩৪ হাজার ৬০০ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ফলে সীমান্তবর্তী ফুলগাজী, পরশুরাম, ছাগলনাইয়া ও ফেনী সদরের আংশিক নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে ভোগান্তিতে পড়েছেন হাজার হাজার মানুষ। বিভিন্ন সড়ক পানিতে তলিয়ে গিয়ে বন্ধ রয়েছে যান চলাচল। বন্যার্ত এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ ও নেটওয়ার্ক না থাকায় মানুষের বিপদ আরও বেড়েছে।এখন ধীরে ধীরে বন্যার পানি নেমে যাচ্ছে, আর ভেসে উঠছে ক্ষয়ক্ষতির চিত্র। পরশুরামে অর্ধশতাধিক ঘরবাড়ি পানিতে ধসে পড়েছে। ফুলগাজীতে পানিতে ডুবে পচে গেছে রোপা আমন ধান। আবার কারো ধান বালুর স্তুপে ঢেকে গেছে। ফলে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন হাজারো কৃষক।আক্ষেপ করে ফুলগাজীর উত্তর শ্রীপুর এলাকার বৃদ্ধা রেজিয়া বেগম জানান, বছর না ঘুরতেই আবারও পানিতে ডুবতে হয়েছে। সব জিনিসপত্র ভিজে নষ্ট হয়ে গেছে। এ অঞ্চলে জুলাই-আগস্ট মাসে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে ভাঙন এখন নিয়মে পরিণত হয়েছে। সবমিলিয়ে মাঝেমধ্যে মনে হয়, এখানে জন্মগ্রহণ করে ভুল করেছি।শুধু রেজিয়াই নন, বারবার একই পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়ে এমন দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে জেলার উত্তরের ফুলগাজী, পরশুরাম ও ছাগলনাইয়া উপজেলার লাখো মানুষকে। এবারও তিন দিনের ভারী বৃষ্টিপাত ও ভারতের উজানের পানিতে মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনিয়া নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ২৩টি স্থানে ভাঙন দেখা দিয়েছে।ফুলগাজীর উত্তর শ্রীপুর এলাকার বাসিন্দা আলী আজ্জম বলেন, বাঁধের ভাঙন স্থানে তীব্র স্রোতে পানি ঢুকছে। সময়ের সঙ্গে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। গত বছরের বন্যার মতো এবারও বিদ্যুৎ ও মোবাইল নেটওয়ার্ক সমস্যা নিয়ে ভুগতে হচ্ছে। রাজনৈতিক দল বা ক্ষমতা পরিবর্তন হলেও আমাদের ভাগ্য কখনো পরিবর্তন হয় না।গাইনবাড়ি এলাকার বাসিন্দা পুষ্পিতা রাণী বলেন, ঘরবাড়ি পানিতে ডুবে গেছে। পরিবারের শিশু ও বয়স্কদের নিয়ে অবর্ণনীয় কষ্ট করতে হচ্ছে। শুকনো খাবার ও নিরাপদ পানির সংকটে আরও বেশি দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের কিছু কর্মকর্তার দায়সারা কাজের জন্য প্রতি বছর এ জনপদে ভাঙন নিয়মে পরিণত হয়েছে। এখন টেকসই বাঁধই আমাদের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য একমাত্র সমাধান।বন্যায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পরশুরাম, ফুলগাজী উপজেলা। দুই উপজেলার ৮০ শতাংশের বেশি মানুষ বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অন্তত ৫০ শতাংশ বাড়িঘর। এ ছাড়া দুই উপজেলার পয়োনিষ্কাশনের ব্যবস্থা ও সুপেয় পানির সুবিধা একেবারে অচল হয়ে গেছে বলা চলে।এখন পানি ধীরে ধীরে নামতে শুরু করলেও দুর্গতদের মধ্যে জীবিকা হারানো ও খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই দুই উপজেলার বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর প্রতিদিন দুই বেলার বেশি খেতে পারছে না। পয়োনিষ্কাশনের ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় খোলা জায়গায় মলমুত্র ত্যাগ বাড়ছে, যা ডায়রিয়া ও কলেরার মতো পানিবাহিত রোগের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। অনেকেই এসব রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন।ফেনীর ফুলগাজী উপজেলার বন্যাদুর্গত হোসনে আরা (৪০) নিজের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, ‘বন্যার সময় পরিবার নিয়ে আমরা বাড়ির ছাদে ছিলাম। আমাদের কাছে বিশুদ্ধ খাবার পানি বা খাবার কিছুই ছিল না। টয়লেটও ডুবে গিয়েছিল, এ ক্ষেত্রে মেয়েদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা নিশ্চিত সম্ভব হতো না। আমরা কেবল রাতের বেলা শাড়ি দিয়ে ঘিরে টয়লেটের কাজ সারতাম। এ ছাড়া কিছু করার ছিল না। এই বন্যা আমাদের সবকিছু শেষ করে দিয়েছে।’

ভয়াবহ বন্যায় ফেনীর পরশুরামের আবদুল আলি (৫২) ঘরবাড়ি হারিয়েছেন। তিনি বলেন, এখন বর্ষা এলেই ভয় লাগে, সামান্য বৃষ্টিতেই বাঁধ ভেঙে পানি এলাকায় চলে আসে। ভেবেছিলাম, গত বছরের থেকে কিছুটা উন্নতি হবে, কিন্তু তা হয়নি। এমন ভয়াবহ বন্যার পানি আগে দেখিনি।গত ৮ জুলাই থেকে শুরু হওয়া এই বন্যায় ফেনীর ৪টি উপজেলার বিশাল অংশ পানির নিচে তলিয়ে যায়। এই বন্যায় প্রায় লাখো মানুষ সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অবকাঠামো, বাড়িঘর, কৃষি ও মৎস্য খাত। এসব ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে দুর্গত জনগোষ্ঠীর জরুরি ও ধারাবাহিক মানবিক সহায়তা প্রয়োাজন।বন্যাদুর্গত মানুষের জন্য জরুরিভাবে বিশুদ্ধ খাওয়ার পানি, নগদ অর্থসহায়তা, খাদ্য ও স্বাস্থ্য সুরক্ষাসামগ্রী প্রয়োজন। মধ্য মেয়াদে ঘরবাড়ি মেরামত, পানি ও পয়োনিষ্কাশনের ব্যবস্থা পুনরুদ্ধার এবং খাদ্য উৎপাদনে কৃষি উপকরণ সরবরাহ এবং দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের পুনর্বাসন নিশ্চিত করা ও আয়মূলক কার্যক্রম পরিচালনা করা জরুরি।বন্যার শুরু থেকেই অবশ্য বন্যাকবলিত এলাকাগুলোতে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জরুরি সহায়তা কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। দুর্গত এলাকায় বিশুদ্ধ খাওয়ার পানি, শুকনো খাবার, ওরস্যালাইন ও পানি দেওয়া হয়েছে। তবে এখন তারা ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোতে ভেঙে পড়া ঘরবাড়ি পুনর্নির্মাণ, নিরাপদ পয়োনিষ্কাশনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা, স্বাস্থ্য সুরক্ষাসামগ্রী প্রদান ও খাদ্য সরবরাহ করতে হবে। তাছাড়া বন্যার ক্ষয়ক্ষতির অবস্থার তুলনায় তাৎক্ষণিক ও দীর্ঘমেয়াদি প্রয়োজন মেটাতে আরও বেশি সহায়তার প্রয়োজন রয়েছে।প্রতিবারই বন্যা আসে, ত্রাণ যায়, মানুষ কিছুদিনের জন্য টিকে থাকে। কিন্তু অনেকেই স্বপ্ন আর স্থায়ী জীবিকা হারায় চিরতরে।