বিচারের মুখোমুখি আ.লীগের শতাধিক মন্ত্রী-এমপি

প্রকাশঃ Jun 23, 2025 - 11:49
বিচারের মুখোমুখি আ.লীগের শতাধিক মন্ত্রী-এমপি

‘যেসব আসামি দেশে আত্মগোপনে রয়েছেন তাদের দ্রুত গ্রেপ্তার এবং যারা বিদেশে পালিয়ে গেছেন, তাদের ফিরিয়ে আনার পদক্ষেপ নেওয়া দরকার’‘যাদের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে, তাদের গ্রেপ্তারে  বাহারুল আলম,মহাপরিদর্শক (আইজিপি) সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাচ্ছে। যারা দেশত্যাগ করেছেন, তাদের ফিরিয়ে আনতে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে বাহারুল আলম, পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি‘র) চেষ্টা চলছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একই সঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট সরকারের দীর্ঘ ১৫ বছরের শাসনামলের পতন ঘটে। জনরোষের ভয়ে শেখ হাসিনার সরকারের আজ্ঞাবহ উপদেষ্টা মন্ত্রী-এমপিসহ সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা আত্মগোপনে চলে যান। গত বছরের ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর শুরু হয় পুলিশসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সংস্কার কাজ। একই সঙ্গে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে গণহত্যার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের শাষনামলের উপদেষ্টাসহ শীর্ষ পর্যায়ের মন্ত্রী-এমপিসহ তৃণমূলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের বিভিন্ন থানা ও আদালতে মামলা দায়ের করা হয়।

শুরু হয় গ্রেপ্তার অভিযান। এরই মধ্যে বিভিন্ন মামলায় অভিযুক্ত আওয়ামী লীগের শাসনামলের সাবেক উপদেষ্টা ও শতাধিক সাবেক মন্ত্রী-এমপি এমনকি আইজিপিসহ সরকারি উচ্চপর্যায়ের অনেক কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করে দফায় দফায় রিমান্ডে নেওয়া হয়। এদের অনেককে রিমান্ড শেষে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। এদের একেক জনের বিরুদ্ধে রয়েছে গণহত্যা, হত্যা, হত্যাচেষ্টা, মানবতাবিরোধী অপরাধ, দুর্নীতি, অর্থ পাচার ও অর্থ আত্মসাতের শত শত মামলা। অভিযুক্তদের অধিকাংশই বিলুপ্ত দ্বাদশ জাতীয় সংসদের সদস্য ছিলেন। তাদের মধ্যে সাবেক মন্ত্রী, উপদেষ্টা, প্রতিমন্ত্রীও রয়েছেন। তারা এখন বিচারেরর মুখোমুখি। বিভিন্ন মামলায় গ্রেপ্তারের পর এ পর্যন্ত সাতজন মন্ত্রী জামিনে রয়েছেন। অনেকের সম্পত্তি জব্দ করাসহ দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞাও দেওয়া হয়েছে। এসব মামলায় অনেক মন্ত্রী-এমপি কারাগারের চার দেয়ালের ভেতর নিজেদের অপকর্ম নিয়ে এখন বন্দি জীবনে দুশ্চিন্তায় ভুগছেন। গ্রেপ্তার এড়াতে এখনো অনেক মন্ত্রী-এমপি দেশের ভেতরই আত্মগোপনে রয়েছেন। আবার অনেকেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাড়ি দিয়েছেন। সমাজ ও অপরাধ বিশ্লেষক ড. তৌহিদুল হকের মতে, যেসব আসামি দেশে আত্মগোপনে রয়েছেন তাদের দ্রুত গ্রেপ্তার এবং যারা বিদেশে পালিয়ে গেছেন, তাদের ফিরিয়ে আনার পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। এদিকে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম বলেছেন, যাদের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে, তাদের গ্রেপ্তারে পুলিশ সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাচ্ছে। যারা দেশত্যাগ করেছেন, তাদের ফিরিয়ে আনতে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে চেষ্টা চলছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত বছরের জুলাইয়ের শুরুতে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে সোচ্চার হয়ে ওঠে শিক্ষার্থীরা। সময় যত গড়াতে থাকে, আন্দোলন আরও বেগবান হতে শুরু করে। একপর্যায়ে শেখ হাসিনার সরকার শিক্ষার্থীদের আন্দোলন দমাতে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন সংস্থাকে কঠোর নির্দেশনা দেয়। এরপর পুলিশ শিক্ষার্থীদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালানো শুরু করে। গত বছরের ১৬ জুলাই রংপুরে বেরোবি ক্যাম্পাসের অদুরেই পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান বেরোবি’র শিক্ষার্থী আবু সাঈদ। তার মৃত্যুর পরই ক্ষোভে ফুঁসে ওঠে সারা দেশের শিক্ষার্থীরা। এরপর শুরু হয় একের পর এক কর্মসূচি। সবশেষ ঢাকা ব্লকেড কর্মসূচির পাশাপাশি সরকার পতনের একদফা দাবিতে মাঠে নামে ছাত্র-জনতা। গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা।

জনরোষের ভয়ে পর্যায়ক্রমে পালাতে শুরু করেন শেখ হাসিনার উপদেষ্টা, সাবেক মন্ত্রী-এমপি ও দলের তৃণমূলের নেতাকর্মীসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তারা। ঘটনার পর টানা ৩ দিন গোটা দেশ ছিল থমথমে পরিস্থিতি। ছিল না কোনো সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ছিলেন নির্বিকার। গত বছরের ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হয়। এরপর দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে শুরু হয় সব দপ্তর ও মন্ত্রণালয়সহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন সংস্থায় সংস্কার কার্যক্রম। একের পর রদবদল প্রক্রিয়ায় জনমনে স্বস্তি ফিরতে শুরু করে। পরবর্তীতে জুলাই আন্দোলনে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের ঘটনায় হত্যা, হত্যাচেষ্টা, গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ, দুর্নীতি ও অর্থ পাচারের ঘটনায় ঢাকাসহ সারা দেশের বিভিন্ন থানায় ও আদালতে মামলা করেন ভুক্তভোগীরা।

ওইসব মামলায় আসামি করা হয় সাবেক প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনাসহ তার আজ্ঞাবহ সাবেক উপদেষ্টা, মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী-উপমন্ত্রী-এমপি, আইজিপি, ডিএমপি কমিশনার, সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তা এমনকি আওয়ামী লীগ ও সহযোগী অঙ্গ সংগঠনের তৃণমূলের নেতাকর্মীদের। ঢালাও মামলায় গ্রেপ্তার এড়াতে নিজ নিজ এলাকা ছেড়ে আত্মগোপনে চলে যান অভিযুক্তরা। এরই মধ্যে শেখ হাসিনার সাবেক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানসহ শতাধিক মন্ত্রী-এমপিকে গ্রেপ্তার করে দফায় দফায় রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। পরে রিমান্ড শেষে আদালতের নির্দেশে অনেক মন্ত্রী-এমপিকে কারাগারে প্রেরণ করা হয়। নিজেদের অপকর্মের দায়ে কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্টে বন্দি জীবনে দুশ্চিন্তার মধ্য দিয়ে সময় পার করছেন মন্ত্রী-এমপিরা। গোয়েন্দা সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, বিলুপ্ত দ্বাদশ সংসদের অধিকাংশ সদস্যরাও গ্রেপ্তার এড়াতে আত্মগোপনে রয়েছেন। অনেকে পাড়ি জমিয়েছেন বিদেশে। তাদের কেউ ভারতে, কেউ মালয়েশিয়ায়, কেউ যুক্তরাজ্যে, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে অবস্থান করছেন। পুলিশসহ বিভিন্ন সূত্রের তথ্যমতে, গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে ১৫ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের পতনের পর থেকে এ পর্যন্ত গ্রেপ্তার হয়েছেন ১১২ জন সাবেক এমপি, সাবেক মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী। তাদের মধ্যে সাবেক নারী এমপি ১২ জন।