১৫ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ ❑ ১লা জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
৬ই জিলকদ, ১৪৪৫ হিজরি ❑ বুধবার

পরকীয়ায় বলি কেন শিশুরা?

অনলাইন ডেস্ক, অধিকরণ ডট কম

অধিকরণ অনলাইনের সর্বশেষ খবর পেতে গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি অনুসরণ করুন

বিজ্ঞাপন

আশরাফ আহমেদ:

সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের দেশে যেসব সামাজিক ব্যাধি ভয়াবহ রুপ ধারণ করেছে তার মধ্যে শীর্ষে রয়েছে পরকীয়া। প্রতিদিন খবরের কাগজ খুললেই অহরহ শোনা যায় পরকীয়ার ঘটনা।পরকীয়ায় নেশায় আসক্ত হয়ে মানুষ বিবেক ,মনুষ্যত্বকে হারিয়ে অসামাজিক ও খুন-খারাপি কাজে জড়িয়ে পড়ে।এই পরকীয়ার জেরে বাবা বা মায়ের হাতে অবুঝ সন্তান নিহত হওয়ার ঘটনা হরহামেশায় ঘটছে। যা অত্যন্ত হৃদয়বিদারক ও লোমহর্ষক।

বিজ্ঞাপন

নিজের লুকানো সম্পর্ক জেনে ফেলায় কখনো কন্যাকে হত্যা করেছেন বাবা, কখনো নিজের সম্পর্কের পথটি মসৃণ করতে আপন শিশুসন্তানকে হত্যা করছেন মা। আবার স্বামী স্ত্রীকে বা স্ত্রী স্বামীকেও হত্যা করছেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এই হত্যাকাণ্ড আবেগবশত হঠাৎ করে ঘটিয়ে ফেলা হত্যা নয়; রীতিমতো পরিকল্পনা করে আটঘাট বেঁধেই হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটানো হচ্ছে।

পরকীয়া হলো বিবাহিত কোনো ব্যক্তির (নারী বা পুরুষ) স্বামী বা স্ত্রী ছাড়া অন্য কোনো ব্যক্তির সঙ্গে বিবাহোত্তর বা বিবাহবহির্ভূত প্রেম, যৌন সম্পর্ক ও যৌন কর্মকাণ্ড। মানব সমাজে এটি লঘু বা গুরুভাবে নেতিবাচক হিসেবে গণ্য। বিবাহ বর্হিভূত সম্পর্কে জড়িয়ে পড়াকে পরকীয়া বলে তা সে ছেলে বা মেয়ে যেই জড়াক না কেন?

টাইমস অব ইন্ডিয়া ও ডেইলি মেইল অনলাইন জানিয়েছে, কেবলমাত্র পুরুষসঙ্গীর প্রতারণার কারণে ৭০শতাংশ নারী জড়িয়ে পড়েছেন পরকীয়ায়। আবার দেখা যাচ্ছে, বাকিদের মধ্যে ৮৫ শতাংশ স্বামীর চেয়ে অন্যের (যার সঙ্গে পরকীয়ায় জড়ান) কাছে উষ্ণ ভালোবাসা পাওয়া—পরকীয়ার একটি অন্যতম কারণ। ওয়েবসাইটটির জরিপে আরও দেখা গেছে, ১. পুরুষসঙ্গীর খারাপ আচরণ, ২. বিশ্বাসঘাতকতা (শুধু এই কারণে অধিকাংশ নারী পরকীয়ায় জড়ান), ৩. কিছু বদ-অভ্যাস, ৪. রাতে অসংলগ্ন আচরণ, ৫. ইচ্ছার মূল্য না দেওয়া, ৬. বারবার মুঠোফোনে নজরদারি, ৭. শারীরিক মিলনে পুরুষের অনীহার কারণেই মূলত নারীরা পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়ার দিকে ধাবিত হয়েছেন।

পুরুষ কেন এবং কখন পরকীয়ায় জড়ায় তার কিছু কারণ খুঁজে দেখা যায়- ১. পারিবারিক কলহ, ২. একঘেয়ে সম্পর্ক, ৩. অপূর্ণ প্রত্যাশা, ০৪. আকর্ষণ হারিয়ে ফেলা, ০৫ পুরনো অভ্যাস, ০৬. মনোদৈহিক ও সামাজিক কারণ,
সঙ্গীর উদাসীনতা ও দূরত্বের কারণেও অনেক সময় মানুষ পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়ে । অনেক সময় স্বামী-স্ত্রী ব্যস্ততার কারণে, কাজের কারণে হয়তো দূরে চলে যায়। তখন তাদের মধ্যে পরকীয়ার আগ্রহ বাড়ে। এ ছাড়া স্বামী-স্ত্রীর দ্বন্দ্ব, দূরত্ব ইত্যাদির জন্যও অন্যের প্রতি আগ্রহ, আসক্তির ঘটনা ঘটে।

বিজ্ঞাপন

মানি আর না মানি, পরকীয়া একধরনের সম্পর্ক। আবেগ আর শারীরিক আকর্ষণের কাছে বাধাগুলো পরাজিত হয় বলেই মানুষ পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়ে। কিন্তু এই আইনি, সামাজিক বা ধর্মীয় বাধার চেয়েও বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায় তার চারপাশের কাছের মানুষজন। বিশেষ করে ছোট শিশুরা।তাই নিজের সেই বিশেষ সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে নিজের সন্তান কিংবা কাছের মানুষকে সরিয়ে দিতেও দ্বিধা করেন না পরকীয়ায় লিপ্ত পুরুষ/ মহিলা।

বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদ বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত ১০ মার্চ রাতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জের দূর্গাপুর গ্রামে বিষ মেশানো মিষ্টি খাইয়ে দুই সহোদর শিশু ইয়াছিন ও মোরসালিন খানকে হত্যা করে তার মা। টানা সাত মাসের পরকীয়া প্রেম ও দফায় দফায় শারীরিক সম্পর্কের পর প্রেমিক শিশুদের নিয়ে বিয়ে করতে রাজি না হওয়ায় তাদের দুনিয়া থেকে সরাতে পথ খুঁজতে থাকে তারা। একপর্যায়ে বিষ মেশানো মিষ্টি পাঠায় পরকীয়া প্রেমিক। সেই বিষ মেশানো মিষ্টি খাইয়ে দুই সন্তানকে হত্যা করা হয়।

শিশুর প্রতি বহুমাত্রিক সহিংসতার পরিসংখানে দেখা গেছে, ২০১৮ সাথে সহিংসতার শিকার হয় ১০১১ জন, ২০১৯ সালে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১৬২২। পরবর্তী বছর ২০২০ সালে সহিংসতার ঘটনা আরও বেড়ে ১৭১৮-তে দাঁড়ায়। সর্বশেষ ২০২১ সালে এ সংখ্যা ১৪২৬ হলেও ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে এপ্রিলের মাঝেই ৩৬৬ জন। এর মধ্যে পরকীয়ার জেরে অনেক শিশু নিহত হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

পরকীয়ায় শিশুরা বলি হয় কেন?

০১.শিশুরা পরকীয়ায় লিপ্ত পুরুষ মহিলার যৌনকর্ম দেখে ফেলার ভয় ০২. অবৈধ বা গোপন সম্পর্কের স্বাক্ষী রাখতে নারাজ।০৩. পরকীয়ায় লিপ্ত পুরুষ/মহিলা শিশুর দায়িত্ব নিতে অনিহা ০৪.শিশুরা পথের কাঁটা/বোঝা ০৫.পুরুষ/মহিলার মধ্যে হতাশা বিরাজ ০৬. পরকীয়ায় লিপ্ত নারী/পুরুষের কাছে শিশু জঞ্ঝাল । আবার হয়তো পরকীয়ায় জড়িয়েছেন এমন একজন মানুষ যে তাঁর এই সম্পর্কটিকে কোনো রূপ দিতে পারছেন না। সব সময় লুকিয়ে রাখছেন। ফলে তাঁর মধ্যে তৈরি হচ্ছে হতাশা। নিজের হতাশাকে কাটাতে নিজের অপ্রাপ্তিবোধের তাড়না থেকে এমন কাউকে বেছে নেন যিনি প্রতিবাদী নন। সেই দুর্বলের ওপর হিংস্রতা দেখিয়ে একধরনের মানসিক পরিপূর্ণতা পেতে চান।

পরকীয়া রোধে প্রচারমাধ্যমকে হতে হবে দায়িত্বশীল। পরকীয়ার কারণে খুনের সংবাদগুলো এমনভাবে পরিবেশন করতে হবে, যাতে এই সংবাদ থেকে কেউ পরকীয়ার পথকে সুগম করতে খুনকে একটা উপায় হিসেবে বেছে নিতে উৎসাহিত না হয়। পারিবারিক কাঠামোকে শক্তিশালী করতে হবে। স্বামী-স্ত্রী পরস্পরকে গুণগত সময় দেবেন। পরিবারে সহনশীলতা আর মিলেমিশে থাকার চর্চা বাড়াতে হবে।

ধর্মীয় অনুশাসনের মধ্যে ইসলাম ধর্মে পরকীয়া বা ব্যাভীচারির শাস্তি কঠিন থেকে কঠিনতর। ইসলামি রাষ্ট্রসমূহে এর জন্য কঠোর শাস্তির বিধান রয়েছে, যা হলো পাথর নিক্ষেপ করে মৃত্যুদণ্ড প্রদান। বাবা-মার পরকীয়ায় সন্তানের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর এবং সামাজিক সম্পর্ক ও যোগাযোগে বিরূপ প্রভাব ফেলে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা সন্তানের মানসিক বিষণ্ণতার ও আগ্রাসী মনোভাবের জন্ম দেয়। এছাড়া পারিবারিক ও দাম্পত্য সম্পর্কের অবনতিতে পরকীয়া প্রভাব রাখে। পারিবারিক শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে ও পরকীয়া রোধ করতে ধর্মের গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি বলে মনে করি। নৈতিক শিক্ষা জোরালো করার মাধ্যমে নীতিবোধ সম্পন্ন মানুষ তৈরি হলে পরকীয়া কমবে এবং শিশুরা নির্মম হত্যা/বলির হাত থেকে রেহাই পাবে।

লেখক: আশরাফ আহমেদ
সহকারী অধ্যাপক ও সাংবাদিক

বিজ্ঞাপন

সংবাদটি শেয়ার করুন

নিউজলেটার সাবসক্রাইব

জনপ্রিয়

আপনার জন্য আরো কিছু সংবাদ
সম্পর্কিত