১৩ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ ❑ ৩০শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
৪ঠা জিলকদ, ১৪৪৫ হিজরি ❑ সোমবার

লোডশেডিং: দু:সহ যাতনা দূরীভূত হোক

অনলাইন ডেস্ক, অধিকরণ ডট কম

অধিকরণ অনলাইনের সর্বশেষ খবর পেতে গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি অনুসরণ করুন

বিজ্ঞাপন

নাসরীন গীতি

এই আছে এই নেই- এমনই লুকোচুরি খেলায় মেতেছে বিদ্যুৎ। অথচ কথা ছিলো দিন-রাত মিলিয়ে দুই ঘণ্টা লোডশেডিং হবে। এলাকাভিত্তিক এরকমই শিডিউল দিয়েছিলো সরকার। কিন্তু গত কয়েকদিন ধরে রাজধানীতে সরকারের এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের নজির চোখে পড়েনি। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অন্তত আট ঘণ্টাই বিদ্যুৎ পাচ্ছেন না নগরবাসী। কখনো এক ঘণ্টা আবার কখনো দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা পরেও বিদ্যুৎ আসে। একদিকে লোডশেডিং; অন্যদিকে ভ্যাপসা গরমে এক রকম অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে জনজীবন।

বিজ্ঞাপন

বিদ্যুৎ বিভাগের হিসাবে, দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা এখন ২৫ হাজার ৭৩০ মেগাওয়াট। গত কয়েক বছরে এ খাতে নানা উদ্যোগ নেওয়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষমতা বেড়েছে। ফলে লোডশেডিং প্রায় বিদায় নিয়েছিল। বিশেষ করে শহরাঞ্চলে বিদ্যুৎ বিভ্রাট হতো না বললেই চলে। গত ৭/৮ বছরের একটি প্রজন্ম বুঝতেই পারছে না লোডশেডিং কি? কিন্তু গত কয়েক মাসে মাত্রাতিরিক্ত বেড়েছে লোডশেডিং। আর তা এখন প্রকট আকার ধারণ করেছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সম্প্রতি গ্রিড বিপর্যয়ের পর লোডশেডিং কিছুটা বেড়েছে। যদিও সংকট দ্রুত কেটে যাবে বলে আশার আলো দেখাচ্ছে বিদ্যুৎ বিভাগ। বিদ্যুৎ বিভাগের সূত্র অনুযায়ী, দেশে যে পরিমাণ গ্যাস সরবরাহ করা হয়, তার একটি বড় অংশ ব্যবহার করা হয় বিদ্যুৎ উৎপাদনে। গত কয়েক মাস ধরে বিশ্ববাজারে সব ধরনের জ্বালানির দাম বাড়তি থাকায় চাপের মুখে পড়ে সরকার। তাই তেল চালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ ঘোষণা করা হয়। গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতেও উৎপাদন কমিয়ে এনে লোডশেডিং করে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছিল। কিন্তু সেই শিডিউলে গ্রামাঞ্চল বা শিল্পাঞ্চল নেই। শিল্পাঞ্চল আছে এমন এলাকার পাশাপাশি বিদ্যুৎ সরবরাহ স্থিতিশীল রাখা হয় রাজধানীতে। কিন্তু বর্তমানে পরিস্থিতি এমন হয়েছে যে, গত ৭-৮ বছরে শহরের মানুষ বিদ্যুৎ নিয়ে অন্তত এমন পরিস্থিতির মুখে পড়েনি। এতে প্রতীয়মান হয় যে, উৎপাদনস্থল থেকে শুরু করে যেকোনো পর্যায়ে যেকোনো ধরণের বিপর্যয়ে এই খাতে একটি বড় ধরণের বিপর্যয় দেখা দিতে পারে।

এদিকে, বিদ্যুৎ পরিস্থিতি নিয়ে গত কয়েকদিন ধরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ব্যাপক লেখালেখি চলছে। অনেকে বলছেন, এক ঘণ্টা করে তো বিদ্যুৎ যেতেই পারে। লোডশেডিং দিনে দুই তিন ঘণ্টা অস্বাভাবিক কিছু নয়। দেশের বিদ্যুৎ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়নের পরও লোডশেডিং শূন্য করা সম্ভব হয়নি। তাই বিদ্যুৎ বিভাগের পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নেয়া জরুরি।

বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্যানুযায়ী, গত ৮ অক্টোবর (শনিবার), বিদ্যুতের চাহিদা পিকআওয়ারে ছিল ১৩ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট, আর উৎপাদন করা হয়েছে ১১ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট। সে হিসাবে ১৮০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ চাহিদার তুলনায় ঘাটতি দেখা গেছে। এর আগের দিন শুক্রবার, পিকআওয়ারে চাহিদা ছিল ১১ হাজার ৮৯৯ মেগাওয়াট আর উৎপাদন হয়েছে ৯ হাজার ২৪১ মেগাওয়াট, সে হিসাবে ২ হাজার ৬৫৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ঘাটতি থাকতে দেখা যায়।

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য বলছে, দিনে গড়ে দুই হাজারের বেশি মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন কমে গেছে। গ্যাস চালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের অধিকাংশই বন্ধ রাখতে হচ্ছে। তাই লোডশেডিং এর পরিমাণ বাড়ানো হচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে বিদ্যুতের গবেষণা বিভাগও বলছে, যখন জ্বালানি সংকট সামনে আসে তখন পরিকল্পনা করা হয়, বিদ্যুতের যেটুকু ঘাটতি দেখা দেবে তা লোডশেডিংয়ের মাধ্যমে পূরণ করা হবে। কিন্তু এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে দেখা গেছে, জনসাধারণের অনেকেই সরকারকে সহযোগিতা করছে না। বিদ্যুৎ থাকলে অনেকেই আইপিএস, জেনারেটরে পাওয়ার রিজার্ভ করছে। এতে আরো সমস্যা তৈরি হচ্ছে। ফলে লোডশেডিংয়ের সময় বৃ্দ্ধি করতেই হয়।

রাজধানী ঢাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি) এবং ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানির (ডেসকো) সরবরাহ কমেছে। ডিপিডিসির কর্তারাও বলছেন, উৎপাদন কম হচ্ছে। তাই কখনো কখনো লোডশেডিংয়ের সময় বাড়াতে হচ্ছে।

বিজ্ঞাপন

এদিকে, গত ৪ অক্টোবর দুপুর ২টার দিকে জাতীয় গ্রিডের পূর্বাঞ্চলে হঠাৎ বিপর্যয় দেখা দেয়। ফলে ঢাকাসহ দেশের চার বিভাগের একটা বড় অংশ বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়ে। প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু সচিবালয়, প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন এবং কার্যালয়, রাষ্ট্রপতির ভবনও বিদ্যুৎবিহীন হয়ে পড়ে।

এই বিপর্যয়ের কারণে পূর্বাঞ্চল গ্রিডে বিদ্যুৎ উৎপাদন শূন্যে নেমে এসেছিল। ওই সময়ে এক ঘন্টার মধ্যে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল ৮৫টি বিদ্যুৎকেন্দ্র। যা কাটিয়ে উঠতে ছয় থেকে সাত ঘন্টা লেগে যায়।

এর দু’দিন পর গত বৃহস্পতিবার (৬ অক্টোবর), সচিবালয়ে সংবাদ ব্রিফিং করে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছিলেন, নাশকতার উদ্দেশে বিষয়টি ঘটেছে কি না বা যান্ত্রিক ত্রুটি কি না- এসব খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ জ্বালানির আন্তর্জাতিক বাজারে যে অস্থিরতা তৈরি করেছে, তার প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনে।

অথচ হাতেগোণা কয়েকদিন আগেও, শতভাগ বিদ্যুতায়নের পথে এগিয়ে চলা বাংলাদেশে লোডশেডিং হারিয়ে গেছে বলেই সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছিলো। এর মধ্যেই গত কয়েকদিন ধরে রাজধানী থেকে গ্রামাঞ্চলে প্রায়ই বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার খবর মিলছে।

গতকাল, বুধবারও রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ঘন ঘন বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছিলো। বিদ্যুতের অভাবে কলকারখানায় উৎপাদন কমে আসারও খবর আসে। সরকারের ন্যাশনাল লোড ডেসপাচ সেন্টারের হিসাবে, গত সোমবার সারাদেশে ১৪ হাজার মেগাওয়াট চাহিদার বিপরীতে সর্বোচ্চ ১২ হাজার ৮১৮ মেগাওয়াট উপাদনের পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। এদিন চাহিদার তুলনায় প্রায় ৯ শতাংশ কম বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়, যা লোড ব্যবস্থাপনার (লোডশেডিং) মাধ্যমে সমন্বয় করতে হচ্ছে।

পিডিবির হিসাবে, ১৫২টি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের স্থাপিত উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় ২২ হাজার মেগাওয়াট। এর মধ্যে ভারত থেকে আমদানি করা বিদ্যুৎ রয়েছে ১১৬০ মেগাওয়াট। তবে ক্যাপটিভসহ মোট উৎপাদন ক্ষমতা ধরা হয় সাড়ে ২৫ হাজার মেগাওয়াটের মতো।

এর মধ্যে গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্রগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় ৫১ শতাংশ, তেলভিত্তিক এইচএফও ও এইচডিও কেন্দ্রগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় ৩৪ শতাংশ। কয়লা থেকে প্রায় ৮ শতাংশ, আমদানি থেকে ৫ শতাংশ বিদ্যুৎ আসে। বাকিটা পূরণ করে সৌর ও পানিভিত্তিক নবায়নযোগ্য জ্বালানি। পেট্রোবাংলার হিসাবে, আমদানি থেকে ১০০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ আসার কথা থাকলেও তা আসছে অর্ধেক।

সরকারের হিসাবে ২০০৯ সালে দেশে বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা ছিল ২৭টি, যা এখন ১৫২টিতে দাঁড়িয়েছে। বিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতা ২৫ হাজার ৭৩০ মেগাওয়াটে পৌঁছেছে। সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন ১৪ হাজার ৭৮২ মেগাওয়াট (১৬ এপ্রিল ২০২২)। গ্রাহক সংখ্যা ৪ কোটি ৩৬ লাখ। মোট সঞ্চালন লাইন (সা.কি.মি) ১৩ হাজার ৮৮৯। গ্রিড সাবস্টেশন ক্ষমতা (এমভিএ) ৫৬ হাজার ৬২৮, বিতরণ লাইন (কি.মি) ৬ লাখ ২৯ হাজার। সিস্টেম লস ৭ দশমিক ৭৪ শতাংশ (জুন ২০২২)। মাথাপিছু বিদ্যুৎ উৎপাদন (কি: ও: আ:) ৬০৮ দশমিক ৭৬, বিদ্যুৎ সুবিধা প্রাপ্ত জনগোষ্ঠী ১০০ ভাগ, প্রি-পেইড মিটার স্থাপন ৫১ লাখ ৭ হাজার ৪৫২টি এবং সোলার হোম সিস্টেম ৬০ লাখ।

এতো কিছুর পরও এখন লোডশেডিংয়ের আশ্রয় নিতে হচ্ছে। কিন্তু সেটা সহনীয় পর্যায় থেকে ক্রমেই অসহনীয় হয়ে উঠছে। কিন্তু উন্নয়নের চাকা সচল রাখতে এ অবস্থা থেকে উত্তরণ জরুরি। এ কারণে দ্রুত বিদ্যুৎ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার জন্য সরকারকে কর্মপরিকল্পনা নিতে হবে। আর এ জন্য সমন্বিত পরিকল্পনা এখন সময়ের দাবি।

লেখক ও সাংবাদিক

বিজ্ঞাপন

সংবাদটি শেয়ার করুন

নিউজলেটার সাবসক্রাইব

জনপ্রিয়

আপনার জন্য আরো কিছু সংবাদ
সম্পর্কিত