জাতিসংঘের তহবিল সংকটে রোহিঙ্গা শিবিরে মানবিক সঙ্কট ঘনীভূত

মোঃ আহছান উল্লাহ
বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীর মানবিক সহায়তা কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো জানিয়েছে, প্রয়োজনীয় তহবিলের ঘাটতির কারণে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং খাদ্য সহায়তা শিগগিরই বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা (UNHCR) এবং ইউনিসেফ সম্প্রতি সতর্ক করে জানিয়েছে, চলতি অর্থবছরে ঘোষিত ৯৩৪.৫ মিলিয়ন ডলারের সম্মিলিত সহায়তা পরিকল্পনার (Joint Response Plan – JRP) মাত্র এক-তৃতীয়াংশ তহবিল এখনো পর্যন্ত পাওয়া গেছে। বিশেষ করে, UNHCR‑এর নিজস্ব ৩৮৩.১ মিলিয়ন ডলারের আবেদন এর মাত্র ৩০% অর্থ এখন পর্যন্ত নিশ্চিত হয়েছে।
এমন সংকটজনক অবস্থায় রোহিঙ্গা শিশুদের শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যেতে পারে বলে জানিয়েছে ইউনিসেফ। সংস্থাটির মতে, যদি জরুরি ভিত্তিতে নতুন তহবিল না আসে, তবে দুই লাখ ৩০ হাজার রোহিঙ্গা শিশুর শিক্ষা কার্যক্রম জুনের মধ্যেই বন্ধ হয়ে যাবে। এ ছাড়া, স্বাস্থসেবা কার্যক্রমও সেপ্টেম্বরের পর বন্ধ হওয়ার আশঙ্কায় রয়েছে।
তহবিল সংকট ও শিবিরে নিরাপত্তাহীনতা বৃদ্ধির কারণে রোহিঙ্গারা বিপজ্জনক নৌপথে দেশত্যাগের চেষ্টা করছে। চলতি বছরের মে মাসেই দুটি নৌকাডুবির ঘটনায় অন্তত ৪২৭ জন রোহিঙ্গা নিহত হয়েছেন। জাতিসংঘ উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছে, হতাশাগ্রস্ত রোহিঙ্গারা তাদের জীবন ঝুঁকিতে ফেলে সাগরপথে পলায়নের চেষ্টা করছে, যা একটি বড় মানবিক বিপর্যয়ের ইঙ্গিত।
একাধিক মানবাধিকার সংস্থা, বিশেষ করে ফোর্টিফাই রাইটস জানায়, কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরে বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠী, যেমন ARSA (Arakan Rohingya Salvation Army), সন্ত্রাস-ভিত্তিক কার্যকলাপ চালাচ্ছে। শিবিরে হত্যা, অপহরণ, জোরপূর্বক নিয়ন্ত্রণ এবং হুমকি এখন নিত্যদিনের ঘটনা। গত মাসে ARSA‑র শীর্ষ নেতা আতাউল্লাহ আবু আম্মার জুনুনি–কে গ্রেপ্তার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, যা পরিস্থিতির ভয়াবহতাকে আরও সামনে নিয়ে আসে।
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে গৃহীত রেজ্যুলেশনে ২০২৫ সালের মধ্যভাগে একটি উচ্চপর্যায়ের আন্তর্জাতিক সম্মেলন আয়োজনের প্রস্তাব রাখা হয়েছে। এই সম্মেলনের মূল লক্ষ্য হবে রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছামূলক, নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করা এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায়বদ্ধতা আরও জোরালো করা।
বাংলাদেশ সরকার বারবার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে রোহিঙ্গা সংকটে সক্রিয় ভূমিকা নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে আসছে। সরকার বলছে, এ সংকট শুধু বাংলাদেশের নয়—এটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ও নিরাপত্তার বিষয়। যথাযথ অর্থায়ন ও দায়িত্ব ভাগ করে নেওয়া ছাড়া এই মানবিক বিপর্যয় থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়।
২০১৭ সালের আগস্টে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে জাতিগত নিধন ও সহিংসতা থেকে প্রাণে বাঁচতে প্রায় ৭ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। বর্তমানে কক্সবাজার ও ভাসানচরে মোট রোহিঙ্গা সংখ্যা প্রায় ১১ লাখ। তাদের খাদ্য, চিকিৎসা, শিক্ষা ও নিরাপত্তার সম্পূর্ণ দায়ভার এখনো বাংলাদেশের কাঁধেই রয়ে গেছে।
জাতিসংঘ ও অন্যান্য মানবিক সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, এখনই প্রয়োজন দ্রুত ও টেকসই সমাধান—অন্যথায় এই ‘চাপা আগুন’ একদিন ভয়াবহ বিস্ফোরণে রূপ নিতে পারে।