ব্যাংকগুলোতে সরকারের সাড়ে ৫২ হাজার কোটি টাকা তারল্য সহায়তা; গুজব নাকি সত্য!

প্রকাশঃ Jul 3, 2025 - 18:21
ব্যাংকগুলোতে সরকারের সাড়ে ৫২ হাজার কোটি টাকা তারল্য সহায়তা; গুজব নাকি সত্য!

গত ১১ মাসে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে প্রায় সাড়ে ৫২ হাজার কোটি টাকা ছাপিয়ে দুর্বল ১২টি ব্যাংকের চলতি হিসাবের ঘাটতি সমন্বয় ও তারল্য সহায়তা প্রদান করেছে। সম্প্রতি গণমাধ্যমে বিষয়টিকে অতিরঞ্জিত করে প্রচার করছে। এ নিয়ে পতিত ফ্যাসিস্টের দোসরদের মধ্যে উচ্ছাস শুরু হয়েছে! পলাতক হাসিনার কিছু অনুসারী ইতোমধ্যে প্রচার করছে- হাসিনা সরকার আর ইউনুস সরকারের তফাত কী? হাসিনা লুটপাট করেছে, ইউনুস আর তার সাঙ্গপাঙ্গরাও লুটপাট চালচ্ছে! বরং, ইউনুসের সরকারের লুটপাটের গতি ও মাত্রা অনেক বেশি। ক্ষমতা গ্রহণের মাত্র ১১ মাসেই এতো টাকা লুটপাট!

আসলেই কি লুটপাট চলমান? আসুন জেনে নেই। প্রচার হওয়া ৫২ হাজার ৫০০ কোটি টাকার মধ্যে ১৯ হাজার কোটি টাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের সাথে কয়েকটি ব্যাংকের চলতি হিসাবে ঘাটতি সমন্বয় করে ঋণে রুপান্তর করা হয়েছে। প্রশ্ন আসে চলতি হিসাবে ঘাটতি কেমন করে হলো? দেশের সব ব্যাংকের শেষ ভরসা হলো বাংলাদেশ ব্যাংক। সব ব্যাংকই বাংলাদেশ ব্যাংকের সাথে চলতি হিসাব মেইনটেইন করে। নিয়ম অনুযায়ী, বাংলাদেশ ব্যাংকে রক্ষিত চলতি হিসাবে যেকোনো ব্যাংকের মোট আমানতের ন্যূনতম ৪% টাকা জমা থাকবে।

আইন অনুযায়ী, কোনো ব্যাংকের চলতি হিসাবে নেগেটিভ ব্যালান্স বা ঘাটতি থাকার সুযোগ নেই। অথচ ১৪ আগস্ট ২০২৪ এর সমকাল পত্রিকার খবর অনুযায়ী ৭ টি ব্যাংকের চলতি হিসাবে ঘাটতি ছিলো ২৯ হাজার ৫৯৭ কোটি টাকা। এদের মধ্যে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক- ১০ হাজার ৬১১ কোটি টাকা, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ- ৭ হাজার ১২৮ কোটি টাকা, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক- ৪ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা, ন্যাশনাল ব্যাংক- ৩ হাজার ৪৭৯ কোটি টাকা, ইউনিয়ন ব্যাংক- ২ হাজার ৭৯৪ কোটি টাকা, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক- ৭১২ কোটি টাকা এবং বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক ৩৯২ কোটি টাকা।

কেনো চলতি হিসাব ঘাটতি? নেপথ্যে কারা?
ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের সুবিধাভোগী পলাতক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার এই ঘটনার মূল কারিগর। শেখ হাসিনার পরিবারসহ কতিপয় ব্যক্তিকে দেশ লুটের সুযোগ করে দিয়েছিলো যার শুরু করেছিলো ড. আতিউর রহমান পরবর্তীত আরেক গভর্নর ফজলে কবির। ব্যাংক লুটেরারা নিজেদের ব্যাংকের সব টাকা লুট করেই থেমে যায়নি বরং বাংলাদেশ ব্যাংকও লুট করেছে। আর এ কাজে তাদের সহায়তা করেছে স্বয়ং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরসহ উর্দ্ধতন কর্মকর্তাগণ।

৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে দায়িত্ব গ্রহণের পর ডুবতে বসা দেশের ব্যাংক খাতকে পুনরুদ্ধারে এই খাতে ব্যাপক সংস্কারের উদ্যোগ নেয় অন্তর্বর্তীকালীণ সরকার। নতুন মুদ্রা ছাপিয়ে ১২টি ব্যাংকের সাথে তাদের চলতি হিসাবগুলোর ঘাটতি সমন্বয় করে সেগুলো ঋণে পরিণত করার পাশাপাশি ১০ হাজার ৫৯৭ কোটি টাকা খেলাপী ঋণ আদায়ও করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। 

৫২ হাজার ৫০০ কোটি টাকার মধ্যে ১৯ হাজার কোটি টাকা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাথে থাকা ঘাটতি সমন্বয় করে বাকি ৩৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা কোথায় গেলো? এই টাকাগুলো বাংলাদেশ ব্যাংক ধার দিয়েছে আর্থিকভাবে দুর্বল কয়েকটি ব্যাংককে। যারা আগস্ট পরবর্তী সময়ে তাদের আমানতকারীদের আমানত ফেরত দিতে পারছিলো না।

ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের চাহিদামত আমানত ফেরত দিতে পারছিলো না? কারণ লুটেরা হাসিনা, তার বোন শেখ রেহানাসহ তাদের পরিবার এবং এস আলম, সালমান এফ রহমান এবং সাইফুজ্জামান চৌধুরীর ও তাদের কয়েকজন অলিগার্ক রাষ্ট্রীয় শক্তি ব্যবহার করে এই ব্যাংকগুলো লুট করেছে।  ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের মোট আমানত ৪২ হাজার কোটি টাকা, মোট ঋণ ৬৩ হাজার কোটি টাকা। ঋণের প্রায় পুরোটাই লুট করে নিয়ে গেছে ফ্যাসিস্ট হাসিনার পারিবারিকভাবে ঘনিষ্ট ব্যবসায়ী এস আলম। ইউনিয়ন ব্যাংকের মোট আমানত ২৪ হাজার কোটি টাকা, মোট ঋণ ২৭ হাজার কোটি টাকা। ঋণের প্রায় পুরোটাই লুট করে নিয়ে গেছে এস আলম। গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের মোট আমানত ১২ হাজার কোটি টাকা, মোট ঋণ ১৩ হাজার কোটি টাকা। ঋণের প্রায় পুরোটাই লুট করে নিয়ে গেছে এস আলম। ন্যাশনাল ব্যাংক লুট করেছে শেখ হাসিনার সাথে পারিবারিকভাবে ঘনিষ্ট জয়নুল হক শিকদারের পরিবার, এস আলম ও অন্যরা। এক্সিম ব্যাংক লুট করেছে ফ্যাসিস্ট হাসিনার অর্থ যোগানদাতা নজরুল ইসলাম মজুমদার ও অন্যরা। শেখ হাসিনার মদদপুষ্ট নজরুল ইসলাম মজুমদার বাগিয়ে নিয়েছিলেন বাংলাদেশ এ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি) এর চেয়রম্যানএর পদ। বিএবি’র চেয়ারম্যান হয়ে দুর্নীতির মাধ্যমে সেখান থেকে হাতিয়ে নেন ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি। যার অডিট কার্যক্রম এখনও চলমান।

সরকারি মদদে লুট হয়েছে পদ্মা ব্যাংক, আইএফআইসি ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, ইউসিবি, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক ও কমার্স ব্যাংক।

৫ই আগস্টের পর এসব লুটপাটের খবর জনগণের সামনে প্রকাশ হতে থাকে। তখন সাধারণ আমানতকারীরা এসব ব্যাংকের শাখায় আমানত ফেরত পেতে ভীড় করেন। উদ্ভব হয় এক নজিরবিহীন পরিস্থিতির। গ্রাহক ব্যাংকে আমানত ফেরত না পেয়ে হাউকাউ, হট্টগোলের মত পরিস্থিতি সৃষ্টি করে।

পরিস্থিতি এমন গুরুতর হয়েছিলো যে, কিছু ব্যাংকের শাখার কর্মীরা পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন, গ্রাহকরা কিছু ব্যাংকে তালা লাগিয়ে দিয়েছিলেন, অনেক ব্যাংকের চেক অনার হচ্ছিলো না, অনেক ব্যাংকের অনলাইন লেনদেন বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। এমনকি, কিছু ব্যাংকের কর্মীরা বেতন পাচ্ছিলেন না।

পরিস্থিতি সামাল দিতে বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন সময়ে লুট হওয়া ব্যাংকগুলোকে শুধুমাত্র গ্রাহকদের আমানত ফেরত দেবার শর্তে অল্প অল্প করে তারল্য সহায়তা দিয়েছে। ১২ টা ব্যাংককে তারল্য সহায়তা দেয়া হয়েছে ৩৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা যা ব্যাংকগুলোর মোট আমানতের ৫% এরও কম। তাও, একবারে নয়; সময়ে সময়ে, অল্প অল্প করে দেয়া হয়েছে এই তারল্য সহায়তা। 

তারল্য সহায়তা পাওয়া ব্যাংকগুলোর মধ্যে সোশ্যাল ইসলামি ব্যাংক পেয়েছে ৮ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকা, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামি ব্যাংক পেয়েছে ৭ হাজার ৫৫০ কোটি টাকা, এক্সিম ব্যাংক পেয়েছে ৯ হাজার ৯৫০ কোটি টাকা, ইউনিয়ন ব্যাংক পেয়েছে ৪ হাজার ৬০০ কোটি টাকা, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক পেয়েছে ২ হাজার ৩৩৬ কোটি টাকা। 

কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে তারল্য সহায়তা দিয়ে আদতে জনগণের আতঙ্ক কমানো হয়েছে। ব্যাংক ব্যবস্থার ওপরে সাধারণ মানুষের আস্থা টিকিয়ে রা