রম্যরচনা : ঢাকার টেসলা

ব্যাটারির গর্জনে বেহেশতের টিকিট

May 7, 2025 - 18:04
ব্যাটারির গর্জনে বেহেশতের টিকিট

ঢাকার রাস্তায় চলাফেরা মানেই প্রতিদিন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এক নতুন অভিযানে নামা। কেউ যায় অফিসে, কেউ যায় মার্কেটে, কেউ যায় প্রেমের ডেটে, কিন্তু একবার যদি আপনি ভুল করে বা সাহস করে ব্যাটারিচালিত রিকশায় চড়ে বসেন, তবে বুঝে যাবেন, আপনি আর সাধারণ যাত্রী নন, আপনি হচ্ছেন ভবিষ্যতের সাহসী নায়ক, যার জন্য অপেক্ষা করছে একশত হর্ন, হাজারো ব্রেকফেল, আর মিলিয়ন ওল্ড ব্যাটারির ঈর্ষণীয় এক্সিলারেশন।

এই যানবাহনকে অনেকেই মায়া করে “টেসলা” বলে ডাকেন। ঢাকায় নামেই টেসলা, কামে বাঁশের কাঠামো, পাতলা টিনের ছাউনি, আর রঙচঙে ফিতা দিয়ে বানানো এক অদ্ভুত ডিজাইনের উড়ন্ত কৌটো। যেটা না উড়ে, শুধু ঝাঁকি দিয়ে আপনার দেহ ও মনকে একসাথে কাঁপিয়ে তোলে।

একেকটা ব্যাটারি রিকশা দেখতে এমন যে, মনে হয় শিশু শ্রেণির কোনো ছাত্র একটা প্রকল্প করছিল, আর তার দাদু সেটাকে রাস্তায় চালানোর উপযোগী করে ফেলেছে। মাথার উপর ছাদ, ছাদের উপর ছাউনি, ছাউনির উপর আবার একটা পলিথিন, বৃষ্টি হলে যেন চালক নিজেই ছাতা না খুলে ছাউনির নিচে লুকিয়ে বলে, “আল্লাহ ভরসা!”

এই যানগুলোতে শব্দ হয়? না, শব্দ বলে কিছু না, এখানে একটা আত্মার চিৎকার চলে। চালু করলেই “ঘররররর...ঝ্যাঁআআআআ...ঠ্যাং ঠ্যাং ঠ্যাং...” এমন এক অপূর্ব মিক্সিং শব্দ হয়, যেটা শুনে পাশের রিকশার চালক নিজের রিকশা থামিয়ে বলে, “ভাই, ব্যাটারি বদলাইছি কোন দোকান থেইকা?”

এই টেসলার সবচেয়ে ভয়ানক দিক হচ্ছে এর অপ্রতিরোধ্য গতি। আপনি ভাবছেন ব্যাটারিচালিত, নিশ্চয়ই ধীরে যাবে? না, ভাই। এই গতি দেখে মনে হয় যেন ব্যাটারির ভেতর হিরোশিমার নিউক্লিয়ার শক্তি ঢুকানো! আপনি যদি চালককে বলেন, “ভাই, একটু আস্তে যান”, সে আপনাকে এমনভাবে তাকিয়ে বলবে যেন আপনি ওর ব্যক্তিগত গতি-বিশ্বাসে আঘাত করেছেন। বলবে, “ভাই, আমাগো ব্যাটারি নতুন, রাস্তা ফাঁকা, আপনে লাইফ এনজয় করেন।”

রিকশার ভেতরে বসলে আপনি বুঝবেন,  আপনি আরেকটা দুনিয়ায়। সিটে বসলে সামনে থাকে চালকের পিঠ, পাশে ঝোলানো কাঁচা কলা, কখনো আবার এক বোতল তেল, মাঝেমাঝে গলায় ঝুলছে চালকের চার্জার। পেছনের আয়নায় চালক নিজের চেহারা দেখে গান গায়, আর সামনের আয়নায় আপনি নিজের চেহারা দেখে প্রার্থনা করেন।

এই রিকশা যখন বাঁক নেয়, মনে হয় যেন টাইটানিক একটা আইসবার্গের দিকে ঘুরছে, না জানি কার ভবিষ্যৎ কোথায় গিয়ে ঠেকে! প্রতিটা বাঁক মানে হচ্ছে একটা ছোটখাটো এক্সিডেন্ট থেকে বেঁচে ফেরার অভিজ্ঞতা। যে যাত্রী প্রথমবার এই রিকশায় ওঠে, সে পরে নিজেকে ধর্মীয় কাজে নিয়োজিত করে ফেলে।

চালকদের গল্পও মজার। একবার এক চালক বললো, “ভাই, আমি আগে বিমানে কাজ করতাম।” আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কী করতেন?” সে বললো, “বিমান ঘাসে চড়াইতাম, এখন রিকশা উড়াই।”

আর দুর্ঘটনার কথা বললে তো শেষ করা যাবে না। প্রতিদিন কারও না কারও সঙ্গে সংঘর্ষ হয়। টেসলা আরেকটা টেসলার সঙ্গে ধাক্কা খেলে, উভয়ের চালক নেমে একে অপরকে বলে, “তোর ব্রেক ঠিক আছিল?” অন্যজন বলে, “ভাই, ব্রেক আছিল, কিন্তু রাস্তা ছিল না!” এক যাত্রী তো একবার বলেই ফেললো, “এই টেসলায় উঠা মানে বিয়ের পরেই গার্ডিয়ানের সামনে প্রেমিকের পুরান চিঠি পড়া,  থ্রিল গ্যারান্টিড, বাঁচা নয়!”

এই যানগুলোতে যে পরিমাণ ঝাঁকি হয়, সেটা ফিজিওথেরাপির ১৫ দিনের কোর্সের সমান। ঘাড়, কোমর, হাড়, সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সচল করে দেয়। ডাক্তারদের কাছে এটা নতুন থেরাপি হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে , “টেসলা শক থেরাপি”।

ট্রাফিক পুলিশরা এই রিকশাগুলো দেখে এমনভাবে সাইড দেয় যেন তারা বুঝে গেছে, এদের থামানো মানে নিজেকে বিপদে ফেলা। আইন, নিয়ম, এগুলো টেসলার চালকদের কাছে শুধুই গুজব। ওদের মতে, “যে আগে যাবে, সে বাঁচবে।” তাই ওভারটেক করা, ফুটপাত দিয়ে চালানো, সিগন্যাল ভেঙে চলা, সব কিছুই স্বাভাবিক।

অবশ্য এই টেসলারা শুধু বেপরোয়া না, এরা সাংস্কৃতিকভাবেও সমৃদ্ধ। চালকদের কারও পেছনে লেখা থাকে, “মা’র দোয়া টেসলার গতি”, আবার কারও রিকশায় দেখা যায় “তুই আমার জান, কিন্তু ব্রেক আমার পুরান!”

তবে যাই বলি, ঢাকার এই ব্যাটারিচালিত টেসলারা এখন আমাদের জীবনের অঙ্গ হয়ে উঠেছে। যতই বেপরোয়া হোক, যতই ঝুঁকি থাকুক, আমরা তবু এই যানেই যাই অফিস, বাজার, প্রেমিকা কিংবা প্রতিবেশীর বাসায়। কারণ, এই যানটাই দেয় সস্তায় অ্যাডভেঞ্চার, এবং বিনামূল্যে রোলার কোস্টারের থ্রিল।

তাই যারা বলে টেসলা একমাত্র আমেরিকায় চলে, তাদের বলি, একদিন সময় করে ঢাকার গলিতে এসো। এখানে টেসলা চলে না, বুকফাটা ব্যাটারির ঝাঁকিতে জীবনই চলতে থাকে!