আন্তর্জাতিক বুকারে মুসলিম হৃদয়ের গাঁথা

May 25, 2025 - 11:26
আন্তর্জাতিক বুকারে মুসলিম হৃদয়ের গাঁথা

নিঃসন্দেহে এটি একটি ঐতিহাসিক অর্জন— ভারতের কন্নড় ভাষায় লেখা একটি বই আন্তর্জাতিক বুকার পুরস্কারের মতো বিশ্বসেরা সাহিত্যের স্বীকৃতি পেল। লেখক বানু মুশতাকের ছোটগল্প সংকলন ‘হার্ট ল্যাম্প’ দক্ষিণ ভারতের মুসলিম নারীদের জীবনের গভীর বেদনা, লুকোনো যন্ত্রণা ও নীরব প্রতিরোধকে এক সংবেদনশীল ও সাহসী ভাষ্যে তুলে ধরেছে।

এই পুরস্কার শুধু একটি সাহিত্যিক স্বীকৃতি নয়, এটি রাজনৈতিকভাবেও তাৎপর্যপূর্ণ। এমন এক সময়ে যখন ভারতে মুসলিম সম্প্রদায় এবং বিশেষ করে মুসলিম নারীরা সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে নানা চাপে রয়েছেন, সেই প্রেক্ষাপটে ‘হার্ট ল্যাম্প’ যেন তাদের নীরব কণ্ঠস্বরের প্রতিধ্বনি হয়ে উঠেছে। বইটির প্রতিটি গল্পেই উঠে এসেছে গৃহের অন্দরমহলের নিঃশব্দ হাহাকার, শরীর ও আত্মার ওপর চালানো শাসনের রূপ, এবং সেই সঙ্গে নিঃশব্দ অথচ প্রবল প্রতিরোধের ভাষা।

এই সংকলনের গল্পগুলো লেখা হয়েছে ১৯৯০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে—তিন দশক ধরে। সময়ের বিস্তৃত এই পরিসর লেখককে তার চরিত্রদের জীবনের বিবর্তন দেখাতে দিয়েছে পর্যাপ্ত অবকাশ। গল্পগুলোতে আমরা দেখি কীভাবে একজন নারী ধর্মীয় অনুশাসনের ভিতর আটকে থেকেও নিজের স্বর টিকিয়ে রাখেন—কখনো চিঠিতে, কখনো স্বপ্নে, কখনো কোনো নিরীহ সেলাইফোঁড়ার কায়দায়। এই গল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে নিখুঁত ভাষার কারুকাজ, দেহরাজনীতি, দৈনন্দিন নির্যাতনের বিষণ্ণ অথচ কাব্যিক চিত্র এবং আশা-নিরাশার দোলাচলে দুলতে থাকা মানুষের মর্মবেদনা।

দীপা ভাস্তির ইংরেজি অনুবাদ এই কাজটিকে আন্তর্জাতিক পাঠকের কাছে পৌঁছে দিয়েছে। অনুবাদ কেবল ভাষান্তর নয়, এটি একটি সাংস্কৃতিক সেতুবন্ধ, যেখানে স্থানীয় বাস্তবতা বিশ্বসাহিত্যের পরিসরে নতুনভাবে প্রতিফলিত হয়। দীপার অনুবাদ কাজ গল্পগুলোর সংবেদনশীলতাকে নষ্ট না করে বরং আরও গভীরতা দিয়েছে।এই প্রথম কন্নড় ভাষার কোনো সাহিত্যকর্ম আন্তর্জাতিক বুকার পেল। এটি কেবল বানু মুশতাকের ব্যক্তিগত বিজয় নয়, এটি ভারতীয় আঞ্চলিক ভাষাসাহিত্যের জন্য একটি যুগান্তকারী মুহূর্ত। বাংলাসহ অন্য আঞ্চলিক ভাষার লেখকদের জন্যও এটি এক বড় অনুপ্রেরণা। এই পুরস্কার প্রমাণ করে দিল, স্থানীয় অভিজ্ঞতা আর আঞ্চলিক ভাষা দিয়েও বিশ্বসাহিত্যে কথা বলা সম্ভব।‘হার্ট ল্যাম্প’ মূলত একটি নীরব বিপ্লবের ভাষ্য। এটি দেখায় কীভাবে সাহিত্য একান্ত ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাকে রাজনৈতিক করে তোলে। আর সেই রাজনীতি যদি হয় নারীর জীবন, দেহ, ধর্ম, প্রেম, প্রতিবাদ ও কষ্টের রাজনীতি, তাহলে সেই সাহিত্য হয়ে ওঠে জীবনেরই একটি রূপান্তর। বানু মুশতাক ও দীপা ভাস্তিকে এই সাহসী ও সংবেদনশীল কাজের জন্য অভিনন্দন। এই বই এখন কেবল একটি পুরস্কারজয়ী গ্রন্থ নয়, এটি দক্ষিণ এশিয়ার নারীদের অন্তর্জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল।