শেষ চিঠি

রোমিও অনুব্রত
নিরুদ্দেশের কবিতা লেখা সহজ কাজ নয়। এসেনিনকে তাই করতে হয়। এমন নয় যে কবিতা লেখার ঠিকানা তার নেই। বরং একটা নয়…কয়েকটা আছে। এই যেমন ধরা যাক সোফিয়ার কথা। গত তিন মাস হল তার থেকে ১৬ বছরের বড় সোফিয়ার সাথে তার খুব গভীরতা হয়েছে। দুজনেই দুজনের কুয়োর ভিতর যখন তখন একজন আরেকজনকে নামিয়ে নিচ্ছে। কাল রাতেও প্রেম গলিয়ে অনেক আনন্দ করেছে তারা। এসেনিন শক্ত করে সোফিয়াকে নিজের সাথে চেপে ধরে বলেছে, “তোমার ভিতরে মাথা গুঁজে দম বন্ধ হয়ে মরে যেতে ইচ্ছে করে। কিংবা ধরো, কাঁটা না বেছে একটা লাল গোলাপ পুঁতে দিলাম”! এসব কথার মানে বোঝে না সোফিয়া। এসেনিন নিজেও হয়ত বোঝে না। কিন্তু এইসব কথা খুব শীতে আগুনের আঁচের মতোই ভালো লাগে সোফিয়ার কাছে।
এখন দুপুর বারোটা। সিগারেটের ধোঁয়ায় ঘরটা কেমন ঘোলাটে হয়ে আছে। জানালার পাশের সোফাটায় বসে আছে সোফিয়া। ধোঁয়ার কুণ্ডলী ছুড়ে দিচ্ছে এসেনিনের দিকে। তার দিকে ভেসে আসতে থাকা একেকটা ধোঁয়ার বৃত্তের দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে এসেনিন। সে বৃত্তের ওপাশে দেখতে পাচ্ছে দুপুরবেলা হঠাৎ লক আউট হওয়া কোনো কারখানা আর সেখান থেকে বের হয়ে আসতে থাকা শ্রমিকদের ঢল। ড্রেন দিয়ে ভেসে যাচ্ছে পোড়া মবিলের কালো স্রোত। একটা মরা বেড়ালের বাচ্চা সেখানে ডুবছে-ভাসছে, ডুবছে-ভাসছে.. একটা ছেলে শ্রমিকদের উল্টো দিকে ড্রেনের পাশ দিয়ে হাটছে। একটা মোড় ঘুরতেই থামতে হলো। একটা লাশ! ভেজা জামা। উপুড় হয়ে পড়ে আছে। হাতদুটো পিছমোড়া করে দড়ি দিয়ে বাঁধা। একপাশে মাথা কাত হয়ে আছে। চোখ দুটো একটু আগে উপরে ফেলা হয়েছে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে রাস্তা। ছেলেটা দাঁড়িয়ে আছে। আশেপাশে উপড়ানো চোখদুটো খুঁজছে তার দৃষ্টি। নেই! কিন্তু কোথায়.. আর শ্রমিকেরা ওদিকেই-বা চলে যাচ্ছে কেন! তাদের তো এই লাশ কাঁধে নিয়ে মিছিল করার কথা.. কই… একটা মানুষও তো…বিহ্বল চোখ নিয়ে তাকিয়ে থাকা এসেনিনকে জিজ্ঞেস করল সোফিয়া, কী ভাবছো এত বলো তো?ভাবছি কারখানার ড্রেন দিয়ে যে আলকাতরা ভেসে যায়, তা নিয়ে একটা ছবি আঁকব। একটা মেয়ের মুখ। ধরো সিসিফির মুখ।নামটা এখন না বললে কী হতো না!সিসিফি তোমার থেকেও বেশি নখরামো জানত। আমি ঘুমের ভিতরে এখনও ওর আঁচড়ের গন্ধ পাই..স্টপ ইট!!ওকে। আমার না খিদে পেয়েছে!দেখো তুমি দশটা মেয়ের সাথে শুতে পারো। কিন্তু আমাকেই বেশি ভালোবাসতে হবে! বাসতেই হবে..বাসি তো! সাত দিন হলো একটা লাইনও লিখতে পারিনি। সব যে তোমার ভিতর গলিয়ে দিয়েছি।আমারও খুব খিদে লেগেছে। জানো, খালি পেটে সেক্স করলে বেশি এনজয় করা যায়।ও। কী খাবে?-তোমায় খাবো। আসো, আসো বলছি!আমি আর কতদূর আসতে পারি বলো!সোফিয়া দুই হাত প্রসারিত করে বলল, এই যে.. এতদূরএসেনিন উঠে বিছানায় সোফিয়ার পাশে এসে বসলো। সোফিয়া তার কাঁধের দিকে মাথা ঝুকিয়ে অনুনয়ের সুরে বলল, কই..এসেনিনের ঠোঁটের কাছে সোফিয়ার ঠোঁট। অন্তত সাত-আটজন পুরুষের পিপাসা মিটিয়েছে তার ঠোঁট। তাও নিজের তৃষ্ণা মেটাতে পারেনি। ঠোঁট এগিয়ে দেওয়ার সময় চোখের ভাষা সেইরকমই আদিম। কোনো রমণীর প্রথম দিকের কামনার মতো।একটা ব্যাপার সোফিয়ার সাথে মেলে না এসেনিনের। কামনার খেলায় সোফিয়া একেবারেই সময় নেয় না। কিন্তু এসেনিনের ভালো লাগতো যদি চুমু খাওয়ার সময়গুলোতে শুধু ওর মুখের দিকেই সারাজীবন তাকিয়ে থাকা যেত।চুমু খাওয়ার ফাঁকে জানালার দিকে চোখ পড়ে যায় এসেনিনের। একটা ছোট্ট রবিন এসে বসেছে। জানালার কাচের ওপাশে। কী সুন্দর রঙ! মা খুব পাখি পছন্দ করে। কতটা পছন্দ করে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। প্রতিদিন মায়ের বারান্দায় বিকেল ৫টায় পাখিরা খাবার খেতে আসে। একদম ঘড়ির কাঁটা দেখে। দেখার মতো একটা দৃশ্য। সেই ছোটবেলা থেকে এমনভাবেই চলে আসছে। পাখিরা এসে খাবার না পেয়ে ফিরে যাবে এইজন্য মা কোনোদিন বাইরে কোথাও যায়নি। মা একা থাকে। গম কিনতে গেলেও তো সেই আট ক্রোশ পথ হেঁটে শহরে পৌঁছাতে হয়। কাকে পাঠায়! কী অদ্ভুত.. তারপরও কিছু থেমে থাকে না।ওহ তুমি না! শুধু অন্যমনস্ক হয়ে যাও, এটা খোলো। দেখি আমি..
কণ্ঠস্বরে বিরক্তির সুর থাকলেও সোফিয়া এখন ভীষণ আসক্ত। এসেনিনও জানলা থেকে মন টেনে নিলো। নাহ, এই মেয়েটাকে নিয়ে পারা যায় না। উফ.. অবশ্য সোফিয়ার শরীরের বাসি এই গন্ধটা সত্যিই মাদকতায় ভরা। এমনকি থেলাসেমিয়া রোগীও উঠে বসতে বাধ্য। এসেনিন এবার মন বসাতে পারলো। সেও ক্রমশ ডুবে যাচ্ছে, আঃ.. মুহূর্তের আচ্ছন্নতা এসেনিনকে একবার মহাশূন্যে আর একবার পাতালে নিয়ে যাচ্ছে। সোফিয়াও সম্পূর্ণ বিকারগ্রস্ত। কিন্তু এইসব লুণ্ঠনের মাঝখানেও এসেনিনের চোখ বারবার মনোযোগ হারিয়ে ফেলছে। সে হঠাৎ সোফিয়ার মাথা ঠেলে সরিয়ে ঝপ করে শুয়ে পড়লো। বললো, প্লিজ থামো.. আই কান্ট টেক দিস নাউ..সোফিয়া অবাক হলো না। এসেনিন সবসময় খামখেয়ালি করে। কিন্তু তাই বলে এরকম একটা মুহূর্তে! সোফিয়া খুব বিরক্ত হলো।কী হয়েছে আমায় একবার বলবে!! (সোফিয়া একটু জোরেই কথাটা বলতে বাধ্য হলো)-কিছু না। তুমি যেতে পারো!
-হোয়াট!! আর ইউ ক্রেজি!-দূর হও। তোমাকে আর ভালো লাগছে না।-এক্সিউজ মি! হোয়াট দা হেল আর ইউ ফাকিং এবাউট..-গো আই সে। আই সে গো! (কথাটা চেঁচিয়ে বলে উঠল এসেনিন।)কেঁপে উঠেছিল সোফিয়া। নিজেকে কোনোরকমে সামলে নিয়ে দ্রুত বিছানা থেকে লাফ দিয়ে নেমে বাথরুমে ঢুকলো সে। এসেনিন চিৎ হয়ে শুয়ে রইলো। তার কাছে মনে হচ্ছে ঘরটা কেমন দুলছে। ইস ঘরটা কী তবে সত্যি ভেসে উঠলো আকাশে! কই.. জানালার দিকে তাকালো সে। নাহ, বাইরে ঝড়ো হাওয়া বইছে। সে নেমে এসে জানালার কাচ উঠিয়ে দিলো। কী অদ্ভুত ঠাণ্ডা বাতাস! সে আবারও জানালার পাশে তার প্রিয় জায়গায়টায় বসলো। ওপাশের দেয়ালে পিকাসোর বয় উইথ দা পাইপের প্রিন্টটা দুলছে। একটা সিগারেট ধরালো সে। দেয়ালে হেলান দিয়ে ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকলো। ছেলেটার মুখ একেবারে আনসিরোর মতো। আনসিরোর মতো ভালো ছেলে পৃথিবীতে একবারই জন্ম নেয়। এসেনিনের হঠাৎ নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে হয়। আনসিরোর মতো বন্ধু পেয়েছিল। একবার দুই বন্ধুতে মিলে একটা নতুন জায়গায় গিয়ে পথ হারিয়ে ফেলেছিল। সে এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা। পথ খুঁজে পাওয়ার কোনো আগ্রহ নেই দুজনের। অথচ একটা জায়গায় পৌঁছানো খুব জরুরি। এক আত্মীয়কে কিছু টাকা দিয়ে আসতে হবে। সেখানে একজন