“অভিনেতার স্বাধীনতা মানেই টিমওয়ার্ক”—নির্মাতা ইফফাত জাহান মম

নতুন প্রজন্মের নির্মাতা ইফফাত জাহান মম সামাজিক সচেতনতা, আবেগ ও বাস্তবতার এক অনন্য মিশ্রণে তার কাজগুলো উপস্থাপন করেন। সম্প্রতি তার পরিচালনায় ‘ব্যথার বাগান’ ওয়েব ফিকশনটি দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছে। কিঙ্কর আহসানের গল্প অবলম্বনে নির্মিত এই নাটক এবং তার সামগ্রিক নির্মাণধারা নিয়ে কথা বলেছেন তিনি দৈনিক আধিকরন-এর সঙ্গে।
দৈনিক আধিকরন: ‘ব্যথার বাগান’-এর গল্প বেছে নেওয়ার পেছনে কোন বার্তাটি পৌঁছাতে চেয়েছেন?
ইফফাত জাহান মম: গল্পটি আমাদের শেখায়—জীবনে একবার হোঁচট খেলে তা জীবন শেষ হয়ে যায় না। একবার ভালোবেসে ধোঁকা খাওয়া মানে এই নয় যে জীবনে আর ভালোবাসা আসবে না। পরিবার, বন্ধু—এই সম্পর্কগুলো জীবনের সবচেয়ে বড় শক্তি। এই কাজের মাধ্যমে আমি বলতে চেয়েছি, জীবনে কেউ না কেউ আসবেই, যে সত্যিকারের ভালোবাসবে, যত্ন নেবে, পাশে থাকবে।
দৈনিক আধিকরন: কিঙ্কর আহসানের গল্প নাট্যরূপ দিতে গিয়ে সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং কোন দিকটা ছিল?
ইফফাত জাহান মম: খুব বেশি চ্যালেঞ্জিং কিছু ছিল না। কারণ তিনি সবসময় সহজ, সরল ভাষায় মানুষের জীবনের কথা বলেন—যা সরাসরি দর্শকের হৃদয়ে গিয়ে পৌঁছে। এটাই তার সবচেয়ে বড় শক্তি।
দৈনিক আধিকরন: আপনি কি নিজেকে একজন সামাজিক সচেতন নির্মাতা ভাবেন?
ইফফাত জাহান মম: অবশ্যই। আমি মনে করি, নির্মাতা হিসেবে দায়িত্বশীল হওয়া জরুরি। আমরা যা তৈরি করি, তা দর্শকের অবচেতনে প্রভাব ফেলে। তাই প্রতিটি কাজেই আমি কোনো না কোনো বার্তা রাখার চেষ্টা করি। যেমন এই রোজার ঈদে বানিয়েছি “Is It Her Fault?”—যেখানে নারীদের নিরাপত্তা ও স্বাধীনতার বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে।
দৈনিক আধিকরন: একটি ওয়েব ফিকশন নির্মাণে গল্প, অভিনয় না কি সংলাপ—আপনার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কোনটি?
ইফফাত জাহান মম: তিনটিই গুরুত্বপূর্ণ। গল্পের গভীরতা, অভিনয়ের প্রাণবন্ততা ও সংলাপের শক্তি মিলেই একটি কাজ দর্শকের মনে দাগ কাটে।
দৈনিক আধিকরন: তৌসিফ মাহবুব ও আইশা খানের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?
ইফফাত জাহান মম: অসাধারণ। বিশেষ করে তৌসিফ ভাইয়ের কথা বলতেই হয়। তিনি একজন প্রতিষ্ঠিত তারকা হলেও অত্যন্ত বিনয়ী ও পেশাদার। কাশবনের শুটিংয়ে তার দামী জুতো নষ্ট হয়ে যায়, তবুও একটুও বিরক্ত হননি। এই ডেডিকেশন খুবই প্রশংসনীয়।
দৈনিক আধিকরন: অভিনেতা নির্বাচনে আপনি নিজে সিদ্ধান্ত নেন, নাকি টিমের ওপর নির্ভর করেন?
ইফফাত জাহান মম: দুটি দিকই দেখি—গল্পের প্রয়োজন এবং দর্শকের চাহিদা। আমরা যে কনটেন্ট বানাই, তা দর্শকের জন্য। তবে গল্পের উপযোগিতা অনুযায়ী নতুন স্বাদও যোগ করার চেষ্টা করি।
দৈনিক আধিকরন: একজন নির্মাতা হিসেবে আপনি অভিনেতাদের কতটুকু স্বাধীনতা দেন?
ইফফাত জাহান মম: এখন একজন নির্মাতা হিসেবে, আমি ‘অভিনেতার স্বাধীনতা’ বলতে বুঝি—টিমওয়ার্ক। পরিচালক এবং অভিনেতা যত বেশি দলগতভাবে কাজ করবেন, ততই কাজের মান উন্নত হবে।
দৈনিক আধিকরন: গল্প নির্বাচনের সময় আপনি কী বিষয়গুলো মাথায় রাখেন?
ইফফাত জাহান মম: গল্পের বার্তা, বাস্তবতা ও দর্শকের সঙ্গে সংযোগের জায়গাটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। দর্শক যদি গল্পে নিজেকে খুঁজে পান, সেটিই সবচেয়ে বড় সফলতা।
দৈনিক আধিকরন: আপনি কীভাবে একটি গল্পকে শ্রোতার মনে গেঁথে দিতে চান—চিত্রায়ণে না আবেগে?
ইফফাত জাহান মম: আবেগ এবং চিত্রায়ণ—দুটিই। কারণ হৃদয় না ছুঁতে পারলে কোনো কাজই টেকে না।
দৈনিক আধিকরন: প্রেম এবং মানসিক টানাপোড়েন বিষয়ক কাজ করার পেছনে কোনো ব্যক্তিগত অনুভব আছে কি?
ইফফাত জাহান মম: অবশ্যই। আমাদের জীবনে, কিংবা আশেপাশের মানুষের জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো থেকেই গল্পের জন্ম হয়। সেসব আবেগ থেকেই নির্মাণ।
দৈনিক আধিকরন: ‘মুনতাসীর’ ও ‘ব্যথার বাগান’ নিয়ে দর্শকদের প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল?
ইফফাত জাহান মম: দুটোর প্রতিক্রিয়াই দারুণ ছিল। তবে এদের তুলনা চলে না। ‘মুনতাসীর’ একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য ফিল্ম—যেখানে পুরুষদের যৌন হয়রানি নিয়ে কাজ করেছি। অন্যদিকে ‘ব্যথার বাগান’ একটি ড্রামা ফিকশন। দুটি মাধ্যমের ভিন্নতা থাকলেও দর্শকের ভালোবাসা পেয়েছি—এটাই বড় প্রাপ্তি।
দৈনিক আধিকরন: কোনো সমালোচনা বা ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে কি এই কাজগুলো নিয়ে?
ইফফাত জাহান মম: এখনো পর্যন্ত খুব বড় কোনো ভুল বোঝাবুঝির মুখোমুখি হইনি। দর্শক সবসময় আমার পাশে থেকেছে।
দৈনিক আধিকরন: সামনে আপনি কী ধরনের গল্প নির্মাণে আগ্রহী?
ইফফাত জাহান মম: কমার্শিয়াল ফিল্ম বানানোর ইচ্ছা আছে। ২০২৬ সালের মধ্যে একটি বাণিজ্যিক চলচ্চিত্র মুক্তি দেওয়ার পরিকল্পনা করছি। তবে নাটক, শর্টফিল্ম, বিজ্ঞাপন—এসবও চালিয়ে যাব।
দৈনিক আধিকরন: যদি বাজেটের সীমাবদ্ধতা না থাকত, আপনি কী ধরনের প্রকল্প নির্মাণ করতে চাইতেন?
ইফফাত জাহান মম: তখন নিশ্চয়ই বড় পরিসরের আন্তর্জাতিক মানের সিনেমা নির্মাণ করতাম—যেখানে গল্প, প্রযুক্তি ও নির্মাণশৈলী মিলিয়ে এক নতুন অভিজ্ঞতা দিতাম দর্শকদের।
দৈনিক আধিকরন: নির্মাতা হিসেবে আপনার সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা কে বা কী?
ইফফাত জাহান মম: আমি নিজেই। রক্ষণশীল পরিবার থেকে এসেছি। কোনো সাহায্য ছাড়াই এই ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ শুরু করেছি। নিজের অভিজ্ঞতা, সংগ্রামই আমার প্রেরণা।
দৈনিক আধিকরন: নারী নির্মাতা হিসেবে ইন্ডাস্ট্রিতে কী ধরনের অভিজ্ঞতা হয়েছে?
ইফফাত জাহান মম: আমি জেন্ডার ডিসক্রিমিনেশনে বিশ্বাস করি না। নির্মাতা বলতে আমি নারী-পুরুষ আলাদা করে দেখি না। সবাইকেই সংগ্রাম করতে হয়। চ্যালেঞ্জ ছাড়া কিছু অর্জন করা যায় না।
দৈনিক আধিকরন: নতুন নির্মাতাদের জন্য আপনার কী পরামর্শ থাকবে?
ইফফাত জাহান মম: আমি পরামর্শ দিতে চাই না। কারণ এখনকার নতুনরা অনেক স্মার্ট। তারা হোঁচট খেয়ে নিজেই শিখবে—এই বাস্তবতায়ই আমি বিশ্বাসী।
দৈনিক আধিকরন: আপনি কি মনে করেন, একটি গল্প সমাজ বদলাতে পারে?
ইফফাত জাহান মম: অবশ্যই পারে। গল্পের শক্তিই সবচেয়ে বড়। মানুষ যা দেখে, তা থেকে ভাবতে শেখে—সেটাই সমাজ বদলের শুরু।
দৈনিক আধিকরন: নির্মাণের সময় আপনি নিজের ভেতরে কী ধরণের আবেগে ভেসে যান?
ইফফাত জাহান মম: নির্মাতারা সবসময়ই আবেগপ্রবণ হন। আমাদের অভিজ্ঞতা, আশেপাশের মানুষের জীবন, ভালোবাসা, কষ্ট—সবকিছুই আমাদের নির্মাণে উঠে আসে। আমরা গল্পের মধ্য দিয়ে নিজেরাই বারবার নতুন করে জন্মাই।
ইফফাত জাহান মমর চোখে নির্মাণ শুধু পেশা নয়, এক আত্মিক সাধনা। টিমওয়ার্কে বিশ্বাসী এই নির্মাতা বারবার প্রমাণ করছেন—সাহস, সততা ও সংবেদনশীলতা থাকলে সীমাবদ্ধতার মধ্যেও সেরা কিছু সম্ভব। তার ভবিষ্যৎ উদ্যোগগুলো নিয়েও দর্শক নিশ্চয়ই আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষায় থাকবে।