শেখ হাসিনার বাবুর্চির এত ক্ষমতা!

নাম মো. মোশারফ শেখ (৪৮)। ফরিদপুরের সালথা উপজেলার ভাওয়াল ইউনিয়নের বড় কামদিয়া গ্রামের কৃষক রহমান শেখের ছেলে তিনি। মোশারফ শেখ প্রায় ২৭ বছর ধরে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাসার বাবুর্চি ছিলেন। তবে এখন তিনি আত্মগোপনে। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পর থেকে মোশারফ শেখও পলাতক।
সম্প্রতি তার বিরুদ্ধে কৃষকের জমি দখলের অভিযোগ উঠেছে। সালথা উপজেলার বড় কামদিয়া গ্রামের কৃষক মো. চাঁনমিয়া ফকিরের ছেলে মো. সাগর মিয়া মোশারফ শেখের বিরুদ্ধে জমি দখলের অভিযোগ দায়ের করায় বেরিয়ে আসে মোশারফের নানা অপকর্ম, নিরীহ মানুষের ওপর অত্যাচার-জুলুম ও সম্পদের তথ্য।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মো. মোশারফ শেখের বাবা একজন দিনমজুর ছিলেন। পড়ালেখা জানেন না কিছুই। নিজের নামটা পর্যন্ত লিখতে পারেন না। বাবার পৈতৃক সম্পত্তি হিসেবে ভাগ পেয়েছেন মাত্র ৫ শতাংশ জমি। প্রথম জীবনে একটি হোটেলে বাবুর্চির কাজ করতেন তিনি। কোনো কায়দায় ১৯৯৬ সালে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাসার বাবুর্চির চাকরি পান। এরপর থেকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। মোশারফ এখন অঢেল সম্পদের মালিক। জায়গা-জমি, গাড়ি-বাড়ি সবই আছে তার। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকাকালীন নিজ গ্রামের বাড়ির প্রতিবেশী কৃষকের জমি দখলসহ সাধারণ মানুষকে নানাভাবে হয়রানি করারও অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
লিখিত অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাবুর্চি মোশারফ শেখ সালথা উপজেলার বড় কামদিয়া গ্রামের বাসিন্দা। তিনি আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় কৃষক চাঁনমিয়া ফকিরের বড় কামদিয়া ৮১ নম্বর মৌজার ৬১৮ নম্বর দাগের ৪৩ শতাংশ জমি জোরপূর্বক দখল করে বাড়ি নির্মাণ করেন। বিভিন্ন সময় ওই জমি ছেড়ে দিতে বললে মোশারফ হুমকি-ধামকি ও মারপিট করে কৃষক চাঁনমিয়া ফকির ও তার পরিবারকে এলাকাছাড়া করে রাখেন। গত ১ জুন কৃষক চাঁনমিয়ার পরিবারের দখল করা জমি উদ্ধার করতে গেলে মোশারফ ও তার লোকজন বিভিন্নভাবে ভয়ভীতি ও হুমকি প্রদান করেন।
ভুক্তভোগী কৃষক চাঁনমিয়া ফকিরের ভাতিজা মো. সেন্টু ফকির বলেন, শেখ হাসিনার বাবুর্চি মোশারফ শেখ আমার চাচার ৪২ শতাংশ জমি দখল করে পাকাঘর নির্মাণ করেন। তখন আমরা পুলিশ প্রশাসনের কাছে গিয়েও কোনো সমাধান পাইনি। বরং জমি দখল নিয়ে মুখ খুললেই আমাদেরকে মারধর করে ও মামলা দিয়ে এলাকাছাড়া করে রাখতেন বাবুর্চি মোশারফ। তিনি শেখ হাসিনার বাবুর্চি হওয়ায় পুরো বড় কামদিয়া গ্রামের সাধারণ মানুষের ওপর জুলুম-নির্যাতন চালিয়েছেন।
মোশারফ শেখের প্রতিবেশী মো. জামাল শেখ বলেন, মোশারফের বাবা একজন সাধারণ কৃষক ছিলেন। অভাব-অনটনের সংসার চালাতে তিনি অন্যের জমিতে শ্রমিকের কাজ করতেন। ছোটবেলা থেকেই মোশারফ পাবনা শহরের একটি হোটেলে বাবুর্চির কাজ করতেন। ১৯৯৬ সালে তিনি শেখ হাসিনার বাসার বাবুর্চির চাকরি পাওয়ার পর থেকে ক্ষমতাবান ও অর্থশালী হয়ে ওঠেন। বর্তমানে তিনি গ্রামের বাড়ি কামদিয়া গ্রামে ২ বিঘা জমির ওপর বাড়ি করেছেন। মাঠে কমপক্ষে ৩ বিঘা জমি রয়েছে তার।
স্থানীয় বাসিন্দা বাবুল মোল্যা জানান, ফরিদপুর শহরের হাড়োকান্দী এলাকায় প্রায় ১২ শতাংশ জমির ওপর একটি বাড়ি ও রাজবাড়ী রাস্তার মোড় এলাকায় ৮ শতাংশ জমির ওপর একটি বাড়ি রয়েছে মোশারফ শেখের। এছাড়া ঢাকা ও ফরিদপুর শহরে একাধিক ফ্ল্যাট-প্লট ও গাড়ি রয়েছে বলে মোশারফ শেখ নিজেই আগে বলতেন।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, শেখ হাসিনার বাবুর্চি হওয়ার সুবাদে সম্পদ গড়ার পাশাপাশি মোশারফ তার নিজ গ্রামের ত্রাসের রাজত্ব কায়েক করতেন। সাধারণ মানুষের ওপর হামলা-মামলা ও তাদেরকে জিম্মি করে জমি দখল ও সালিশ বাণিজ্য করার চেষ্টাও করতেন। ওই গ্রামের যুবলীগ নেতা নুর ইসলাম তার প্রতিপক্ষ ছিলেন। ২০১৫ সালে যুবলীগ নেতা নুর ইসলামের সমর্থকরা তাকে ধাওয়া দিয়ে এলাকাছাড়া করেন। এরপর তিনি নুর ইসলামের সঙ্গে মিলে ফের এলাকা নিয়ন্ত্রণে নেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বড় কামদিয়া গ্রামের বাসিন্দারা জানান, আওয়ামী লীগের ক্ষমতার বলে এলাকায় প্রচণ্ড দাপট দেখানোর পাশাপাশি ক্ষমতায় অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন মোশারফ শেখ। শুধু গ্রামবাসীর ওপর অত্যাচার করে ক্ষান্ত হননি তিনি, নিজের পরিবারও রেহাই পায়নি তার কাছ থেকে। চার বছর আগে দুই মেয়ে ও এক ছেলেকে আটকে রেখে নিজের স্ত্রীকে জোর করে বাড়ি থেকে বের করে দেন মোশারফ। সেই স্ত্রী এখনও তার বাড়িতে আসার সুযোগ পাননি।
চাঁনমিয়া ফকিরের ছেলে মো. সাগর মিয়া বলেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাবুর্চি মোশারফ শেখ আমাদের জমি দখল করে বাড়ি নির্মাণ করেছেন। তার ক্ষমতায় এলাকার মানুষ তখন ভয়ে কথা বলতো না। আমরা আমাদের জমি ফেরত চাই।
এসব অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে শেখ হাসিনার বাবুর্চি মোশারফ শেখের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। তার ফোন নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়। তার গ্রামের বাড়িতে গিয়েও তাকে এবং তার পরিবারের কাউকে পাওয়া যায়নি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সালথা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আতাউর রহমান বলেন, জমি দখলের বিষয় নিয়ে মোশারফ শেখের বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ পেয়েছি। অভিযোগ তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।